-->

গল্প- বৃষ্টি আপা

বৃষ্টি আপা

-কানিজ সুমাইতা প্রথা (রংপুর)

ফিস থেকে বেরিয়েই রাস্তায় নেমেছি,আজ আর বাসায় ফিরতে মন চাইছে না। তা অবশ্য কখনই চায়না। মায়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে। ভালো একটা ছল পাওয়া গেল। ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়। দূরে কোথাও। কিন্তু কোথায়?

হুট করে বৃষ্টি আপার কথা মাথায় আসল। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নিশ্চিন্তপুর বলে একটা গ্রামে থাকে শুনেছিলাম। এখন আমাদের সাথে সম্পর্ক নেই বললেই চলে, ছোট থেকে বড়ই হয়েছি তার কাছে।  পরে...... সে যাজ্ঞে । অনেকদিন ফোন করে ডেকেছিলো, সময়ের অভাবে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আজ সেখানেই যাওয়া যাক।আপা খুব খুশি হবে। নতুন মোবাইল কেনায় আপার নাম্বারটা আর এখানে তোলা হয়নি। ভারী ঝামেলায় পরা গেল তো! শেষ আপার ওখানে গিয়েছিলাম আপার বিয়ের ২বছর পর, মানে বেশ অনেক বছর আগে। 


পকেটে মোটে আছে ৪০০টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা। মাসের শেষ,হাত প্রায় খালি। বাকরখানি আপার খুব প্রিয়। ১কেজি বাকরখানি নিয়ে যাওয়া যাক, বাকি টাকা যাতায়াতে হয়ে যাবে। লোকাল বাস পাওয়া গেল। পাক্কা ২ঘন্টার জার্নি শেষে সন্ধায় পৌঁছলাম নিশ্চিন্তপুরে।

আপার বাড়ির আশেপাশে কোনো বাড়ি নাই, চারিদিক জংগল। অনেকটা পুরানো বাড়ির মতো। শুনেছিলাম আপার দাদা শশুড় এর আমলের। কতগুলো  বছর ধরে টিকে আছে! তবে আপা বেশ সংসারী মানুষ, বাড়িটাকে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে বলা যায়।

কিন্তু আজ কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে বাড়িটাকে। কেমন যেন অচেনা।

মেইন গেইট দিয়ে ঢুকেই দরজায় কড়া নাড়লাম। ভদ্রতার খাতিরে দুইবার কড়া নেড়ে অপেক্ষা কর‍তে লাগলাম। অনেক্ষণ হয়ে যায় সাড়া পাওয়া যায়না,একসময় ভেবেই নিলাম ফেরত যাব কিনা।

“ইমন!”

পিছন ফিরেই খানিকটা চমকে উঠলাম। চমকে উঠারই কথা! বৃষ্টি আপা! কোত্থেকে এলো! সদর দরজা খোলার আওয়াজ তো পেলাম না। আশে পাশে পাচিল  ছাড়া আলাদা রাস্তাও নেই। 

"আপাকে তবে এতদিনে মনে পড়লো তোর!" খানিকটা লজ্জিত হলাম বটে। 

দুঃখিত গলায় প্রশ্ন ছুড়লাম। 

"কেমন আছো আপা?"

"সে যেমন দেখছিস! হাতে কিরে? কি এনেছিস আমার জন্য?"

আমি তাড়াহুড়ো করে প্যাকেটটা আপার হাতে তুলে দিতে দিতে বললাম,"১কেজি বাকরখানি এনেছি আপা তোমার প্রিয় বলেই...."

কথা শেষ না হতেই আপা প্যাকেট খুলে মুখে ভরতে লাগলো। আপার এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখে একটু ঘাবড়ালাম বটে!

খাওয়া থামিয়ে আপা বললো "ভেতরে চল। " 

আশ্চর্য! দরজা খোলাই ছিল। মনে মনে কতগুলো প্রশ্ন নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। 

ঘরে ঢুকতেই একধরনের তীব্র গন্ধ নাকে লাগলো, অনেকদিন ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে রাখলে যেমন গন্ধ, ঠিক সেরকম।

আপাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, "আমরা তো বেশিরভাগ  বাইরে থাকি তাই এমন। সে যাজ্ঞে, যা কাপড় ছেড়ে আয়, আমি রাতের খাবার বানাই।"


আমাকে যেই রুমটা দেয়া হলো, সেটা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সমান, রুমের একটা মাত্র জানলা, তাও মরিচা ধরে গেছে, অনেক চেষ্টায় ও খোলা গেল না। আর দেয়াল গুলো কেমন স্যাতস্যাতে,কিছু কিছু যায়গায় আবার শ্যাওলাও জন্মেছে। সব ঘরের মতো এই ঘরেও সেই বাজে তীব্র গন্ধটা। তবুও কোনো মতে থাকতে হলো।

"খেতে আয় ইমন," খাবার ঘর থেকে আপার ডাক শুনে খেতে গেলাম।

ডাল, আলুভর্তা আর গরুর গোস্ত। 

আপা আলুভর্তা দূর্দান্ত বানাতো। আপা যখন ভাত বেড়ে দিচ্ছিলো, আমার চোখ যায় আপার নখের দিকে, নখগুলো কেমন যেন কালচে হয়ে গেছে। খিদের চোটে ওসব আর জিজ্ঞেস করা হলোনা।  খাবারগুলোর স্বাদ অন্যরকম লাগছিলো। অনেকদিনের বাসি খাবার যেমন লাগে তেমনি। আপা যে এমন কুৎসিত রান্না করবে তা আমার কল্পনারও বাইরে। খিদের চোটে সবটুকু খেয়ে ফেললাম স্বাদ নিয়ে গবেষণা আর হলোনা। 

" আপা তুমি খাবেনা?"

"আমি তো এখন খাইনা রে, আরো রাত বাড়ুক তখন খাব।"

"আচ্ছা আপা তুমি বাড়িতে একলা যে?দুলাভাই কই?" প্রশ্নটা করতেই আপার মুখ কেমন বেজার হয়ে গেল। 

"সেকি মুখটা এমন বাংলার পাঁচের মতো করলে যে? ঝগড়া হয়েছে বুঝি?"

প্রশ্নের উত্তর তো পেলামই না, উলটো আপা হনহন করে রান্না ঘরে ঢুকে গেল। মনে মনে একটু লজ্জিত হলাম বটে, এভাবে বলাও ঠিক হয়নি, হয়তো ব্যাক্তিগত দৈব-দুর্বিপাকে আছে।


তবে আগে এমন মজা রোজই করতাম। আপা সম্পর্কে আমার ফুপাতো বোন। পড়াশুনার জন্য শহরে আমাদের সাথেই থাকত। তখন আপার কলেজের গণিত শিক্ষক ছিল দুলাভাই। সাধারণত অংক মাস্টার যেমন হয়- তিনি একদমই তেমন নন। দেখতে রোগামত, আর মোটেও রাগি না, একদম চুপচাপ স্বভাবের। আর আপা হলো বিশ্ব সুন্দরী। কোকড়াচুল  কোমর ছুঁই ছুঁই করতো তখন। সরু মুখ, টান টান চামড়া, খানিকটা চাকমাদের মত। খোলা চুলে টিপ দিয়ে সালোয়ার-কামিজ পরে যখন কলেজে যেত, সবাই শুধু প্রস্তাব নিয়ে আসত। আপা আমায় কলেজে কত নিয়ে গেছে, পাহাড়া দিতে! আপার বন্ধুরা সবাই মিলে গণিত পড়ত দুলাভাই এর কাছে। আস্তে আস্তে কি করে যেন দুজনের প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু কারো পরিবারই কাউকে মেনে নিতে চায় না। কারণ দুলাভাই অন্য ধর্মের। ফুপা ফুপু জানতে পেরে শহর থেকে আপাকে নিয়ে যায় গ্রামে।  একরকম ঘর বন্দি করে রেখেছিলো। আমার আম্মা জোড় করে আবার শহরে আনে আপাকে,কারণ আর কদিন বাকি ছিলো আপার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার। একদিন সকালে ঘুম ভাংলো ফুপার ভয়ার্ত কন্ঠে। বাইরে যেয়ে দেখি আম্মাকে ভীষণ ভাবে বকা হচ্ছে, আপাকে শহরে আনায়। কিন্তু কারণ সেটা নয়, কারণ হলো, আপা এক বিশাল চিঠি লিখে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। 


চিঠিতে লেখা-

প্রিয় মামি, 

আপনি আমার বরাবরই প্রিয়। তবে আমাকে মাফ করবেন। আব্বু আম্মু আসলে জানাবেন।  আমি যেখানে সুখী হব সেখানেই চললাম-ইত্যাদি ইত্যাদি.. 


আম্মাকে ফুপা যা নয় তা বলে অপমান করল। মাঝখান থেকে ফুপা ফুপির সাথে আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল। এরপর মাঝে মধ্যেই আপা আমায় কল দিত, দেখতে চাইত।  দুলাভাই আমাকে নিতে যেত একটা পার্কে, দেখা করে আবার বাসায় দিয়ে যেত। একবার আম্মার হাতে ধরা খেলাম। আম্মা সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। ততদিনে আপা বগুড়ায় গেলেন শশুরবাড়িতে। তারপরও  দাদির মোবাইল দিয়ে কথা বলতাম,আপা করুণা করে বলত, ইমন তোকে বড্ড বেশি মনে পরছে রে,দেখার জন্য ছটফট করছে মন টা।  তোকে একটু যদি জড়িয়ে ধরতে পেতাম! আমি তখন নিতান্তই ছোট ছিলাম। আপার আবেগ অতো বুঝতাম না। তারপরে এই কত্তদিন পর আপাকে দেখলাম! এখন আর আগের বেশ নেই,কেমন যেন বয়স্কদের মত চেহারা হয়ে গেছে। চাহনিও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আপাদের বিয়ের ১২ বছর হতে চলেছে, কিন্তু বাচ্চা কাচ্চা নেই। এই নিয়ে অনেক চিন্তা করে আপা, চিন্তার কারণে কতগুলো রোগও বাধিয়ে ফেলেছে। 

খাওয়া শেষ করে ঘরে চলে এলাম। আপা বলল, ঘুমুতে যা, আমার কতগুলো কাজ সেরে তারপর ঘুমুতে হবে। খাটে শুতে গিয়ে দেখি ধুলো ময়লার স্তর জমে গেছে। আপারও বলিহারি ভাই এসেছে আর একটু ঘরগুলো গুছিয়ে দেবেনা! কেমন যেন আচরণ করছে আমার সাথে,একটাবারও খোঁজ নিল না আমার। আমার কথা বাদই দিলাম, নিজের মা-বাবার? আম্মার? আবার আমার সাথে ঠিক মতো কথাও বলছেনা।আপা তো এমন ছিল না কখনো!


বিছানা ঝাড়ার জন্য ঝাড়ু আনতে গেলাম আপার কাছে।  কিন্তু কি আশ্চর্য! পুরো বাড়িতে কোথাও আপাকে পেলাম না।বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বেরিয়ে খোঁজ করতেই ঘরের আবছা আলোয় যেই দৃশ্য চোখে পড়ল, তার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না।  চোখ কপালে ওঠার মত অবস্থা। আমার পুরো শরীর ক্রমশ কাঁপছে, চিকন ঘাম ছুটছে। আমার ঠিক ১০০গজ দূরে আপা। বিশাল একটা মরা গরু দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে মুখে ভরছে, এরপর চিবিয়ে খাচ্ছে,  কাঁচা গোস্তের রক্ত ঠোঁটের এককোনা দিয়ে টপ টপ করে পড়ছে। খাওয়ার সময় কেমন একটা বিশ্রী শব্দ বেরোচ্ছে। চেহারাও কেমন যেন হয়ে গেছে। আপার রাশি খারাপ তা জানতাম, কিন্তু এসব কি! স্বপ্ন দেখছি মনে হচ্ছে। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কি করে পালানো যায়। এক দৌঁড়ে পালাতে পারলেই বাঁচি। কোনোকিছু চিন্তা না করেই এক দৌঁড়ে  হাতের বামের পাচিল টা টপকে বাইরে বের হলাম। পাচিলের ওপাশ থেকে এখনো আপার খাওয়ার বিশ্রী শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, সাথে কান্নার আওয়াজ। আমার ভয় আরো বাড়তে থাকে। আর এক মুহুর্ত না, এখনি বাড়ি ফিরব,এই বলে উঠে যখনই একটা দৌড় দিতে যাব তখনি সংঘর্ষ  এক ভদ্রলোকের সাথে। তিনি ছিলেন সাইকেলে, ভাগ্যিস ব্রেক কষেছিলেন নয়তো কেলেংকারি বেধে যেত। 

"আপনি কে মশাই?  এত রাতে ভূতের বাড়ির সামনে কি করছেন? দেখে তো মনে হচ্ছে এলাকায় নতুন"  ভদ্রলোক সাইকেল থেকে নামতে নামতেই প্রশ্ন করলেন। 

"ভূ ভূ ভূতের বাড়ি মানে?"

আংগুল দিয়ে বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ এই বাড়িকে সবাই ভুতের বাড়ি বলে।"

“মানে?কেন?”

"আজ থেকে ৯ বছর আগে প্রবীর রায় মানে, এ বাড়ির মালিক রবী রায় এর ছেলে। প্রবীর বিয়ে করে কোন এক মুসলিম মেয়েকে, কিন্তু রবীদা কিছুতেই মেনে নেন না এই সম্পর্ক। এরপর রবীদা এবং তার স্ত্রী মারা যাবার পর প্রবীর মেয়েটিকে নিয়ে এখানে ওঠে। বিয়ের ২ বছরে প্রবীর জানতে পারে মেয়েটির মা হবার সম্ভাবনা নেই। প্রবীর তখন আরেকটা সম্পর্কে জরিয়ে পরে এবং মেয়েটিকে তালাক দেবার কথা বলে। মেয়েটি এ খবর শুনে একদিন রাতে বিষ খেয়ে সেখানেই তৎক্ষনাৎ মারা যায়। সেই রাতেই প্রবীর লাশ রেখে সবাইকে খবর দিতে বাইরে বেরোয়, কিন্তু বাড়িতে ফিরে গিয়ে আমরা দেখি লাশ নেই! এ পুলিশ থেকে ও পুলিশ কত খোজাখুজি লাশ কোত্থাও নেই এবং এখনো নিখোঁজ। এরপর কেউ এই বাড়িতে আর থাকতে পারে নি। প্রবীরকে রোজ রাতে জ্বালাতন করত মেয়েটির আত্মা, সে ও বাধ্য হয় এ বাড়ি ছাড়তে। তখন থেকে এখানে প্রতিরাতে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায় । এবং প্রতিমাসে এই তারিখে মানে মেয়েটির মৃত্যুদিনে গ্রামের যেকোনো একটা গরু চুরি হয়। পরেরদিন সকালে আবার পাচিলের এই পাশে হাড়-হাড্ডি পরে থাকে......"

ভদ্রলোক তার মতো করে বলেই যাচ্ছেন। কিন্তু আমার কাছে একটা জিনিস এই মুহুর্তে স্পষ্ট হয়ে গেল। বৃষ্টি আপা বেঁচে নেই,না জানি কত কষ্ট নিয়ে আপা এ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন, তার আত্না হয়ত শান্তিতে নেই। শেষ যেই চিঠিতে আপা লিখেছিল "যেখানে সুখ সেখানেই চললাম " কিন্তু আপা তো সুখে ছিল না!বাড়ি গিয়ে আমি কি জবাব দেব? কিন্ত কয়েক ঘন্টা আগেই আমি যার সাথে গল্প করছিলাম,খাবার খাচ্ছিলাম সেসব কি ছিলো?আর কিছুক্ষণ থাকলেই...  আমার কিছু হয়ে যেত না তো? হয়তো না, আপা যে আমায় বড্ড বেশি ভালো বাসতো,আগে রোজই বলত "ইমন আমার থেকে বেশি কে তোকে ভালোবাসবে"! 


এখনো পাচিলের ওপাশ থেকে আপার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, আমার নিজেরো চোখ শীতল ততক্ষণে, তবুও কতগুলো প্রশ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরছি, আচ্ছা এমনও কি ঘটে?


গল্প- বৃষ্টি আপা গল্প- বৃষ্টি আপা Reviewed by সম্পাদক on বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ২৩, ২০২৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.