-->

ইউনেস্কোর পুরস্কার পেল বাংলাদেশের ভাসমান স্কুল


বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে বর্ষাকাল মানেই নদী-নালা উপচে পড়া পানি, ডুবে যাওয়া গ্রাম আর থেমে যাওয়া পড়াশোনা। এই বাস্তবতা থেকেই স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ান ভাবেন ভিন্নভাবে—শিক্ষাকে ভাসিয়ে রাখার উপায় খুঁজে বের করেন তিনি। ২০০২ সালে স্থানীয় একটি নৌকাকে স্কুলে রূপান্তর করে তৈরি করেন বিশ্বের প্রথম ভাসমান স্কুল।

সম্প্রতি ইউনেস্কোর মর্যাদাপূর্ণ কনফুসিয়াস সাক্ষরতা পুরস্কার ২০২৫ অর্জন করেছে মোহাম্মদ রেজওয়ানের সৌরচালিত এই ভাসমান স্কুল। শিক্ষায় উদ্ভাবন ও জীবনব্যাপী শিক্ষার প্রসারে এটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্বীকৃতি, যা চীনা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেওয়া হয়। শুক্রবার সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থার এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।


চলনবিলের এই স্থানীয় উদ্ভাবন এখন বিশ্বজুড়ে টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থার অনুপ্রেরণা। নাইজেরিয়া, কম্বোডিয়া ও ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে এটি অনুসরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও রেজওয়ানের প্রকল্পকে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ২০৫০-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। বর্তমানে ১০০টিরও বেশি নৌকা স্কুল, লাইব্রেরি ও ক্লিনিক হিসেবে কাজ করছে, যার মাধ্যমে ২২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী সাক্ষরতা অর্জন করেছে।


ইউনেস্কো তিনটি উদ্যোগকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করেছে—বাংলাদেশের সিধুলাই ভাসমান স্কুল, আয়ারল্যান্ডের লার্ন উইথ নালা ই-লার্নিং এবং মরক্কোর সেকেন্ড চান্স স্কুল অ্যান্ড ইনক্লুসিভ এডুকেশন প্রোগ্রাম। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানটি ২৭ সেপ্টেম্বর চীনের শানডং প্রদেশে অনুষ্ঠিত হয়।

ইউনেস্কো জানিয়েছে, “বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে সাক্ষরতা শিক্ষা পৌঁছে দেওয়াই এই প্রকল্পের সাফল্য।”


এক প্রতিক্রিয়ায় মোহাম্মদ রেজওয়ান বলেন, “শিক্ষা শুধু পড়ালেখা নয়; এটি শান্তি, সমতা ও সহনশীলতা গড়ে তোলে। আমি বিশ্বাস করি, জ্ঞানের শক্তি আমাদের এমন ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করবে, যেখানে কোনো দুর্যোগই শিক্ষাকে থামাতে পারবে না।”



বর্তমানে ফ্রান্সের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ইমিগ্রেশন হিস্ট্রি-তে চলছে “বোট স্কুলস অব বাংলাদেশ – ফিউচার দ্যাট ফ্লোটস” প্রদর্শনী। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের তথ্যচিত্র “বাংলাদেশ টার্নস টাইড অন ক্লাইমেট চেঞ্জ উইথ ফ্লোটিং স্কুলস” নির্বাচিত হয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেন গ্লোবাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডস ২০২৫-এর ফাইনালিস্ট হিসেবে। রেজওয়ানের কাজ স্থান পেয়েছে জুলিয়া ওয়াটসনের বই “লো-টেক: ওয়াটারে”-তেও।


রেজওয়ান বলেন, “বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী ও কন্যাশিশুরা, তাই আমরা শিক্ষাকে তাদের জন্য নিরাপদ ও সহজ করেছি। প্রযুক্তি তখনই কার্যকর হয়, যখন তা মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ কারণেই আমাদের ভাসমান স্কুলগুলো স্থানীয়দের মতামতের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এবং পরিচালিত হয়।”


মোহাম্মদ রেজওয়ানের ভাসমান স্কুল শুধু একটি শিক্ষামূলক প্রকল্প নয়, এটি আশার প্রতীক—যেখানে জলই হয়ে ওঠে শিক্ষার পথ। চলনবিলের ছোট্ট এক উদ্যোগ আজ বিশ্বজুড়ে উদ্ভাবন, মানবতা ও টেকসই ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। এই উদ্যোগ প্রমাণ করেছে, সংকট যত গভীরই হোক, সৃজনশীল চিন্তা ও মানবিক দায়বদ্ধতা থাকলে শিক্ষার আলো কখনো নিভে যেতে পারে না।

ইউনেস্কোর পুরস্কার পেল বাংলাদেশের ভাসমান স্কুল ইউনেস্কোর পুরস্কার পেল বাংলাদেশের ভাসমান স্কুল Reviewed by সম্পাদক on শনিবার, অক্টোবর ২৫, ২০২৫ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.