-->

শৈশবের খেলাধুলা।


- জেবা সামিহা তমা,(রংপুর):

আচ্ছা, আপনার সবচেয়ে প্রিয় সময় কোনটা? নিশ্চয়ই আপনার উত্তর হবে 'ছোটোবেলা'। যদি আমি আবার জিজ্ঞেস করি কেনো আপনার ছোটোবেলা সবচেয়ে প্রিয়? তখন আপনি বলবেন ছোটোবেলায় অনেক খেলাধুলা করতেন। আমি নিশ্চিত আপনি একটু বড় হওয়ার পরে যখন নিয়ম বেঁধে পড়াশোনা করতেন তখনও সুযোগ খুঁজতেন কখন খেলতে যাবেন। এর একটাই কারণ। খেলাধুলা আমাদের আনন্দ দেয়। আমাদের বিনোদনের সবচেয়ে বড় ও সুন্দর একটি মাধ্যম খেলাধুলা। অবশ্য খেলাধুলা থেকে যে শুধু আনন্দ পাওয়া যায় তা নয় এর থেকে অনেক জ্ঞান ও অর্জন হয়। 

কিন্তু এই খেলাধুলা কি? দার্শনিক লাডউইগ উইটজেনস্টেইন এর মতে খেলা হলো ঐ সকল শরীরবৃত্তীয় কাজ যার মাধ্যমে আমরা বিনোদন, জ্ঞান অর্জন এবং শরীরচর্চা করতে পারি সেই সাথে আমাদের মানসিক বিকাশ ও ঘটাতে পারি।  খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ এর সময়ও মানব সভ্যতায় খেলাধুলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় খেলাধুলা মানুষই তৈরি করেছে। আমরা জানি যে, জনপ্রিয় ক্রিকেট খেলার উৎপত্তি স্থান ইংল্যান্ডে, ফুটবল খেলার উৎপত্তি স্থান চীনে, দাবা খেলার উৎপত্তি স্থান ভারতে। এই খেলাগুলো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হলে আমাদের দেশের নিজস্ব কিছু খেলা আছে যা আমাদের মধ্যেই অনেক প্রচলিত। শুধুমাত্র বাংলাদেশের খেলা বলতে গেলে প্রায় ৩০ টি খেলার নাম বলতে হয়। এবং এই খেলাগুলো বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমঙ্গেও জনপ্রিয়। 

লাঠি খেলা
লাঠি খেলা

লাঠিখেলা, যার উৎপত্তি বাংলাদেশে। যারা লাঠিখেলে তাদের বলা হয় লাঠিয়াল বা লেঠেল। ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা তাদের নিরাপত্তার জন্যে তাদের সাথে লাঠিয়াল রাখতো। সাড়ে চার ফুট থেকে পাঁচ ফুট লম্বা তৈলাক্ত লাঠি দিয়ে কৌশলের সাথে লাঠি খেলা হয়। 

কুতকুত খেলা

আচ্ছা, এক নিশ্বাসে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা যায়? হ্যাঁ যায় এবং সেটা হলো কুতকুত অথবা কিতকিত। মাটিতে দাগ কেটে আয়তাকার দুইটা ঘর এবং একটি বর্গাকারকে আড়াআড়ি ভাবে কেটে চার ভাগ করা হয়। মোট ৬ টা ঘর এরপর অর্ধচন্দ্রাকৃতি একটি অংশ রাখা হয়। মাটির পাতিলের ছোটো একটা ভাঙ্গা টুকরো খেলায় ব্যবহৃত হয় যাকে বলা হয় গুটি। এক পা শূন্যে তুলে অন্য পায়ের সাহায্যে দম দিয়ে গুটি টাকে খেলার ঘর অতিক্রম করতে হয়। প্রথম খেলোয়াড় সফল হলে সে একটি ঘর কিনতে পারে। এরপর দ্বিতীয় খেলোয়াড় খেলতে শুরু। এভাবেই মুলত খেলা চলতে থাকে। একজন খেলোয়াড় অপর জনের কেনা ঘরে পা দিয়ে খেলতে পারে না তাকে লাফিয়ে সেই ঘর অতিক্রম করে খেলতে হয়। 

বউচি খেলা

এবার আসি বউচি খেলায় যেখানে মূলত সবার থেকে বাঁচিয়ে বউকে ঘরে নিয়ে আসতে পারলেই জেতা যায়। দুইটা দলে ৭/৮ জন করে ভাগ হয়ে যায় এবং একজন বউ থাকে। মাটিতে দুইটা ঘর আঁকা হয় একটা ঘরে একটি দলের বউ থাকে এবং অন্যঘরে দলের বাকিরা। অপর দলের সবাই চারপাশে ঘিরে থাকে। প্রথম দলের ঘর থেকে একজন একজন করে দম দিয়ে অপর দলের খেলোয়াড়দের ছুঁয়ে তাদের খেলা থেকে বাদ দিয়ে দেয়। এভাবে অপর দলের খেলোয়াড় সংখ্যা কমে গেলে বৌ নিজের ঘর থেকে দলের অন্যদের কাছে চলে যায়। বৌ যাওয়ার সময় অপর দলের কেউ তাকে ছুঁয়ে দিলে দলটি হেরে যাবে। 

ফুলটোকা


কে যে আমাকে মারতো বুঝতেই পারতাম না। এমনটা হতো ফুল টোকা বা টোকাটুকি খেলায়। দুজন দলপতি থাকতো। দুজন খেলোয়াড় আড়ালে গিয়ে নিজেদের ছদ্মনাম দিতো। এরপর এসে দলপতিকে জিজ্ঞেস করতো ' কে নিবে আম, কে নিবে জাম '। দলপতিরা আন্দাজে একজনকে বাছাই করতো। এভাবে দুইটা দল তৈরি হয়ে দুই দিকে সারি বদ্ধভাবে বসতো। এরপর দলপতিরা নিজের দলের খেলোয়াড়দের একটি করে ছদ্মনাম দিতো এবং অপর দলের একজনের চোখ বেঁধে রেখে ছদ্মনাম ধরে ডাকতো। সেই খেলোয়াড় নিঃশব্দে গিয়ে চোখ বেঁধে রাখা খেলোয়াড়ের মাথায় টোকা দিয়ে নিজের যায়গায় বসে দলের অন্যদের সাথে ছড়া বলতো। যে খেলোয়াড়ের চোখ বাঁধা ছিলো সে সঠিক খেলোয়াড়কে চিনতে পারলে নিজের অবস্থান থেকে এক ধাপ এগিয়ে যেতো আর না পারলে অপর দল এগিয়ে আসতো। এভাবে যে দল আগে অপর দলের ঘরে পৌঁছাবে সে দল বিজয়ী। 

ডাঙ্গুলি খেলা

ডাঙ্গুলি খেলাটা বলা চলে ক্রিকেট খেলার দেশী সংস্করণ। দুই দলে বিভক্ত হয়ে এটা খেলতে হয়। একটা দুই ফুট লম্বা লাঠি যাকে বলা হয় ডান্ডা আর একটা তিন-চার ইঞ্চির লাঠি যাকে বলার হয় গুলি এই দুই মিলে ডাঙ্গগুলি। মাঠে একটা ছোটো গর্ত করে তার উপর গুলি রাখা হয়। একটি দলের খেলোয়াড় ডান্ডা দিয়ে গুলিকে মেরে সেটা উপরে তুলে আবার মেরে দূরে দেয়ার চেষ্টা করে। গুলি যদি অপর দলের খেলোয়াড় ধরে ফেলে তাহলে আউট আর যদি না ধরতে পারে তবে যতদূর গুলি যায় ততদূর ডান্ডা দিয়ে মাপতে হয়। এই মাপের মধ্যে বেশ কিছু মজার নাম আছে। এভাবেই একের পর এক খেলা চলতেই থাকে। 

ওপেন টি বায়োস্কোপ


"ওপেন টি বায়োস্কোপ

নাইন টেন তেইশ কোপ

সুলতানা বিবিয়ানা

সাহেব বাবুর বৈঠক খানা"

ছড়ার শব্দ শুনে বোঝা যায় ব্রিটিশ আমলে তৈরি এটা। দুইজন দলপতি হয়ে একে অপরের হাত ধরে ফুলের তোরণের মতো তৈরি করে তা উপরে ধরে রাখে। আর বাকিরা একে অপরের ঘাড়ে হাত দিয়ে দলবদ্ধ হয়ে এই ছড়া বলতে বলতে দলপতিদের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে। ছড়ার শেষ অংশে হাত দিয়ে বানানো তোরণের মাঝখানে যে থাকে তাকে দলপতিরা বন্দী করে নেয়। কখনো বন্দীকে বাদ দিয়ে পুনরায় খেলা হয় এবং শেষ পর্যন্ত যে থাকে তাকে জয়ী ধরা হয়। আবার কখনো বা বন্দীকে জিজ্ঞেস করা হয় সে কোন দলে যাবে তারপর দুই দলে বিভক্ত হয়ে আবার খেলা হয়।  

এসব ছাড়াও আরও অনেক খেলা আছে। কড়িখেলা, ইচিং বিচিং, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, পুতুল খেলা, লাটিম খেলা, মার্বেল খেলা, মোরগ লড়াই, ষোলোগুটি। এই খেলাগুলো আমাদের হারিয়ে যাওয়া একটা সুন্দর শৈশব। এই খেলাগুলো যখন প্রজন্মান্তর হয়েছে তখন কিছুটা নিয়ম বদলালেও মূল খেলা কিন্তু একই রয়ে গেছে। আবার অঞ্চলভেদে খেলার ছড়া বা ছড়ার শব্দ কিছুটা বদলে গেছে। গ্রামীণ এই খেলাগুলোর ছড়া হলো আমাদের লোকসাহিত্য। এই খেলাগুলোর জনপ্রিয়তার একটি কারণ কিন্তু এই ছড়াগুলোও। খেলাধুলার এই ছড়াগুলো যেমন মানুষের ভালো লাগে তেমন আবার প্রাণে উদ্যম তৈরি করে। যেমন - নৌকাবাইচের সময় গাওয়া গান। সব মাঝি যখন একসাথে গলা ছেড়ে গান গায় তখন যেনো তারা প্রাণে নতুন উদ্দম পায়। স্থল ছাড়াও আমাদের জলের মধ্যেও অনেক ঐতিহ্যবাহী খেলা আছে। নৌকাবাইচ তাদের মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও ডুবসাঁতার, ব্যাঙ লাফানো খেলা তো রয়েছেই। স্থলের ঐতিহ্যবাহী খেলা বলতে জব্বারের বলী খেলাটা মনে পড়ে। যেটা এখনো আমরা ধরে রাখতে পেরেছি। আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডিও কিন্তু আমাদের নিজস্ব খেলা এবং আমাদের দেশ ছাড়াও অলিম্পিক পর্যন্ত এর বিস্তৃতি রয়েছে। 

আমাদের খেলাগুলোর ঐতিহ্যবাহী হওয়ার আরও একটা কারণ খেলাগুলো বহু প্রাচীন। শোনা যায় ব্রিটিশ আমলে ইংরেজদের ব্যঙ্গ করে ঘুড়ি বানিয়ে তা উড়ানো হতো। ইংরেজ সরকার এটা বুঝতে পারার পর ঘুড়ির কারিগর ও ঘুড়ি উড়ানো সবার শাস্তির হুকুম করেন। নরসিংদীর গ্রামে পাওয়া সেই অঞ্চলের প্রাচীন রৌপ্যমুদ্রায় ষোলো ঘুঁটি ও বাঘবন্দী খেলার খোদাই করা ছক  দেখে ধারণা করা হয় যে এই খেলাগুলো উৎপত্তি মৌর্য বা মৌর্য–পূর্ব যুগে।

এই খেলাধূলা থেকে যেমন আমরা বাংলার মানুষের জীবনধারার তথ্য পাই কিংবা বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধার্মিক জীবনের একটা চিত্র ফুটে উঠে তেমনি এসব খেলা থেকে অনেক জীবনমুখী শিক্ষাও পাওয়া যায়। যেমন দলবদ্ধ হয়ে খেলা থেকে একসাথে থাকার একটা শিক্ষা পাওয়া। এছাড়াও বুদ্ধিভিত্তিক চর্চারও একটা বড় সুযোগ আছে। এই খেলাগুলোয় খেলোয়াড় নির্বাচনের নিরপেক্ষতাও একটা সুন্দর শিক্ষা। আমার মনে হয় পেশাগত জাতীয় বা আন্তর্জাতিক খেলায় যেমন নোংরা রাজনীতির একটা সুযোগ আছে এই খেলাগুলোয় তা নেই। তাই বলতেই পারি বাংলার খেলাগুলো বিশুদ্ধ খেলা।  

আমরা এখন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাঁচার জন্যে প্রযুক্তি নিয়ে ব্যস্ত নয়তো পড়াশোনার পরে চাকুরী জীবন নিয়ে অধিক চিন্তিত। এসবের ভীড়ে হারিয়ে ফেলছি আমাদের গ্রামীণ খেলাধুলা আর ভুলতে বসেছি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আর সাহিত্য। তবুও মনেপ্রাণে চাই আমাদের ও আগামীর মধ্যে জীবিত থাক আমাদের নিজস্ব খেলাধুলা, ভালোভাবে বেঁচে থাকি আমরা। 


ছবি: সংগৃহীত।

শৈশবের খেলাধুলা। শৈশবের খেলাধুলা। Reviewed by সম্পাদক on বুধবার, এপ্রিল ২৮, ২০২১ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.