গল্পঃ ঘোড়সওয়ারি
লেখাঃ জাবির রাফি
" লা লা লা লা।" টাকমাথা ভুড়িওয়ালা বৃদ্ধ কেয়ারটেকারকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলো মিলি। জানে ভূতের অস্তিত্ব নেই, এসব বলে আসলে সন্ধ্যার পরে ওদেরকে বাইরে যাওয়া থেকে আটকাতে চাচ্ছে কারণ বুড়ো ঘুমিয়ে পড়বে সন্ধ্যার পরপরই আর এসব কথা অবাস্তব হলেও কানে ঢুকলে রাতের ঘুম হারাম; তাই মিলি থামিয়ে দিলো বুড়োকে।
"আপনার মজাক মনে হচ্ছে দিদিমণি?" বৃদ্ধ দাতমুখ খিচে বলল।
" না না। আপনার কথা মজাক মনে হবে কেন? আপনার কথার গুরুত্ব আগেই বুঝে গেছি। বুঝেছি যে আপনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন তাদের অস্তিত্বে। শুরু করুন আবার।" বলল মিলি।
"তারা চলে আসবে বাজার পর্যন্ত। এসেই হুড়মুড় করে মারধর শুরু করবে না। তারা লক্ষ্য করতে থাকবে সবাইকে। সেইসমস্ত মানুষ....
" লা লা লা লা লা।" বুড়োকে আবারও থামাল মিলি। হারিকেনের আলোয় দেখলো বুড়ো রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে আছে ওরদিকে। বিষয়টা খেয়াল করলো রাজু। বৃদ্ধকে বলল, " আসলে ওর খুব গান শোনার বাতিক আছে তো তাই মাঝে মাঝেই লা লা লা লা বলে ওঠে। আপনি বলতে থাকুন।"
"বাজারে এসে তারা সবাইকে লক্ষ্য করতে থাকবে, কারা যাচ্ছে ওই নির্দিষ্ট দোকানগুলোয়। কারা কিনছে ওই নির্দিষ্ট জিনিসটা। বিশেষ করে যারা বেড়াতে আসে তাদের উপরে নজর থাকে বেশি। তারপর.....
" লা লা লা লা লা। আচ্ছা জিনিসটা কী?" বলল মিলি। কোনো উত্তর পেল না সে। হঠাৎ ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল কেন মিলি প্রথমে বুঝলো না।
স্মার্টফোনের ফ্লাশ অন করে দেখে রাজু চোখ-নাক-ভ্রু কুচকে চোখ সরু করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
মিলি ফ্লাশটা সারা ঘরে ঘুরিয়ে দেখলো কেয়ারটেকার নেই! হারিকেন নিয়ে চলে গেছে। তাই ঘরটাও অন্ধকার হয়ে আছে।
"আরে তোরা প্যারা নিস না। আমরা সন্ধ্যার পরে বাইরে গেলে যদি দেরি করে ফিরে আসি, আর তাতে বুড়োর ঘুমের ব্যঘাত ঘটে তাই সে অমন গালগল্প শোনাচ্ছে।" খোশ মেজাজে বলল মিলি।
রাজু কিছু বলার আগেই আবারও সে বলে উঠলো, "রাজু-মিঠু, নিজেদের ঘরে চলে যা ভাই। আজ রেস্ট নেই। ওই সামিহা, ফোন রাখ। এই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মাঝেও মেসেজিং করে চোখ নষ্ট করিস না। প্রেমিক গেলে প্রেমিক পাবি। চোখ গেলে চোখ পাবি না।"
পরদিন দুপুর পর্যন্ত ঘুরে, বিকাল পর্যন্ত রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যার ওরা বাইরে বের হলো বুড়োকে ফাকি দিয়ে।
সন্ধ্যায় বাজারে গিয়ে এই দোকান সেই দোকানে এটা সেটা দেখার নাম করে লোকজনের কাছে কথা শুনে নিচ্ছে রাজু আর মিঠু।
লোকজনের কাছে কথা শুনে ওরা বুঝলো বুড়ো একটুও বানিয়ে বলেনি। কিন্তু কোন জিনিসের কথা বলেছে সেটা জিজ্ঞাসা করতেই সবাই বলল, "ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান। ওসব আপনাদের এলাকায়ও পাওয়া যায়। এখানে ওসব কিনে বিপদে পড়ার দরকার নেই।"
একজন দালাল টাইপের লোক ওদেরকে সাইডে ডেকে এনে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই হইচই শুরু হয়ে গেলো। পাহাড় থেকে নামতে শুরু করেছে তারা। সবাই দৌড় লাগাল। মিঠু রাজুও। রাজু ফোন লাগাল মিলিকে।
নদী থেকে পানি নিয়ে কলসি কোমরে নিয়ে বাড়ি ফিরতে থাকা মহিলাদের সাথে কথা জমাচ্ছিল মিলি। আসল কথায় যাওয়ার আগেই হইচই শুনলো ওরা আর মিলির ফোন বেজে উঠলো। ধরতেই রাজু চিৎকার করে উঠলো, "ওই মিলি ভাগ জলদি। ফিরে আয় বাংলোয়!"
মহিলারা হইচই শুনেই হন হন করে হেটে চলে গেল।
মিলি কিচ্ছু বুঝলো না। দাড়িয়েই রইলো। সামিহা তো আরও বোঝেনি কিছু।
"তুই এক বস্তু বটে। এই দুর্বল নেটওয়ার্কেও বাবু খাইছো বাবু খাইছো টাইপের মেসেজিং করছিস! আর এদিকে কী না কী হয়ে গেলো!"
মিলিরর কথা শেষ হতেই কোমরপানির নদী পার হয়ে একদল ঘোড়সওয়ার চলে এলো নদীর এপাশে। এসেই দেখলো মিলি আর সামিহাকে।
এর আগে কক্সবাজারে ঘোড়া দেখেছিল মিলি। চড়েও ছিল। এই ঘোড়াগুলো বড়, অনেক বড়।
সে বলল, "আপনাদের ঘোড়ায় চড়া যাবে?"
ঘোড়সওয়ার ওদের দিকে একবার তাকাল। তারপর নিজেদের দিকে একবার তাকিয়ে ওদের অগ্রাহ্য করে চলে গেল বাজারের দিকে।
মিলি সামিহাকে জিজ্ঞাসা করলো, "কেসটা কী হলো বলতো?"
সামিহা ফোন থেকে মুখ না তুলেই বলল," আরে পাগলী, ওরা তোর কথা বোঝেইনি! তুই ওদের ভাষায় বললে তবেই না বুঝবে ওরা!"
মিলি বলল, "অহ তাই তো। এখন কী করি!"
"কিছু করতে হবে না আপামণি। চলে যান। আর এদের সম্পর্কে খুব বেশি জানতে চাইলে আশরাফ মাস্টারের কাছে যান।" পরিষ্কার প্রমিত ভাষায় বললেন শাড়ি পড়া একজন মহিলা।
"কোথায় পাব ওনাকে? আর আপনি ওনার কে হন?" বলল মিলি।
"এই নদীর পাড় ধরে এগোতে থাকলেই পাবেন ওনাকে। এই উপত্যকায় একটাই পাকাঘর আর সেটাই ওনার।" বলেই যেমন দুম করে এসেছিল তেমন দুম করেই হাওয়া হয়ে গেল মহিলা। মিলি আশেপাশে আর খুজে পেল না তাকে।
রাতে বাংলোয় ফিরেই জেরার মুখে পড়লো মিলি আর সামিহা। বাংলোয় ফিরে ওদেরকে না পেয়ে বুড়োকে জাগিয়েছে রাজু। তারপর পুরো বাজার চষে বেড়িয়েছে ওদের খোজে। পায়নি খুজে।
ঝাড়ি চুপচাপ হজম করলো মিলি। তারপর কী কী হলো সেসব বলল।
শুনেই চোখ কপালে তুলল রাজু। বলল, "আরেহ বাপ রেহ! বুড়ো আমাদের সাপ থেকে বাচার টোটকা দিচ্ছেন আর উনি সাপের সাথেই কথা বললেন। শোন, ঘোড়সওয়ারি তোর কথা বোঝেনি কারণ তারা কেউ এই দুনিয়ার নয়। বুঝলি!"
"বুঝলাম যে তুই রাম ছাগলের ছোট ভাই। শোন, আশরাফ মাস্টারের কাছে যেতে হবে কাল। ওই বুড়ো ভামের সব রহস্য জানেন মাস্টার সাহেব।" বলল মিলি
পরদিন সকালে আশরাফ মাস্টারের কাছে গেল ওরা।
সব শুনে হেসে ফেললেন তিনি।
বললেন, "আরে বুড়ো তো দোকানদারদের দালাল। সবাইকেই একই কথা বলে। পুরোটা বলছি শোনো।
এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। গাড়ির যাতায়াত কম। তো একবার কী কারণে যেন এক গাড়ি আইস্ক্রিম এসেছিল এখানে।সবাইকে ফ্রিতে আইস্ক্রিম খাইয়েছে।
তারপর এখানকার দোকানদাররা ভাবলো আইস্ক্রিম খুব লাভ জনক ব্যবসা হবে। তাই তারা অনেক আইস্ক্রিমের অর্ডার করলো।
কিন্তু দাম দিয়ে কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই এখানকার মানুষের। ফলে আইস্ক্রিম বিক্রি হয় না। যেই কারণে দোকানদাররা আইস্ক্রিম কোম্পানির টাকা পরিশোধ করতে পারে না। বিক্রি হয় না; এই দোহাই দিয়ে তারা টাকাও দেয় না।
এদিকে আইস্ক্রিম কোম্পানি হাফিজুল ডাকাতের লোকদের ভাড়া করেছে পাহারা দিতে। তারাই ঘোড়ায় করে এসে পাহারা দেয় যে কেউ আইস্ক্রিম কেনে কি না। কিনলেই কোম্পানিকে জানিয়ে দিবে আর তারা এসে টাকা চাইবে।
তাই তোমাদের মতো বাইরের লোক এসে যাতে আইস্ক্রিম না কেনে তাই বুড়ো তোমাদের ওই গল্প শোনায়।"
গল্পটা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো! একটু পরেই হাহা হিহিতে মেতে উঠলো সবাই।
গল্পঃ ঘোড়সওয়ারি
Reviewed by সম্পাদক
on
সোমবার, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২
Rating:
Reviewed by সম্পাদক
on
সোমবার, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২
Rating:
