শেখ একেএম জাকারিয়া,(সুনামগঞ্জ):
'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম '
বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধের পথপ্রদর্শক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীপ্তিময় কণ্ঠের এ ভাষণ বাঙালি জাতিকে মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে পুনরায় নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে যা এই সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত, সে স্থানে অনুষ্ঠিত এক জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বে লিখিত ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন। তিনি এ ভাষণ বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। দীর্ঘ আঠারো মিনিটের এই ভাষণে তিনি এদেশের বাঙালিদের স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যুদ্ধের জন্য তৈরি হওয়ার আহবান জানান। বইপত্রাদি পাঠে জানা যায়, ভাষণের একটি লিখিত বিবৃতি অর্থাৎ সাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশিত মতামত, যা সে সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসম্মুখে বিলি করা হয়েছিল। এ বিবৃতি সে সময়ের সৎ ও মেধাবী রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক কিছুটা সংস্কার করা হয়। সংস্কারের আসল অভিপ্রায় ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা।
১৯৭০ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে মােট আসনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি সংখ্যক আসন পেয়ে জয় লাভ করে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের যুদ্ধবাজ শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী মুসলিম লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে থাকে। প্রকৃতপ্ৰস্তাবে তাদের অভিপ্রায় ছিল, যে কোনও ভাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্ব পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ আধিকারিক ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু তার পূর্বেই আকস্মিকভাবে ১লা মার্চ এ অধিবেশন অনির্ধারিত সময়ের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে দেশের জনগণ অসন্তুষ্ট হয়ে
সংঘবদ্ধ আন্দোলনে নামে। r /> আওয়ামী মুসলিম লীগের বিপ্লবী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ পুরোদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বহু মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে় পূর্ববাংলার সবজায়গায় অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আর এ পটভূমিতেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমাবেশে বহু মানুষ একত্রিত হয়। পুরো ময়দান সেদিন বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনসাধারণ এবং সার্বিকভাবে সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন। ভাষণের একটি পর্যায়ে অগ্ন্যুৎপাতকালে আগ্নেয়গিরি থেকে গলিত প্রস্তরাদি, ছাই প্রভৃতি যেভাবে উদগিরণ হতে থাকে ঠিক সেভাবেই হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে বৃষ্টির মতো লাভা অর্থাৎ অতিতপ্ত ধাতব পদার্থ যেন নির্গত হতে শুরু করে, ' ভাইয়েরা আমার, তোমরা আমার উপর বিশ্বাস আছে? আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে... মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
পাকিস্তান সরকার সেদিন (৭ মার্চ ১৯৭১ সাল) রেডিও কিংবা টেলিভিশনে উল্লিখিত ভাষণটি প্রচার করতে দেয়নি। তবে সরকারের কঠোর বারণ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফরিদপুর জেলার পাঁচ আসনে সংসদ সদস্য এম আবুল খায়ের ভাষণটি ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাদের এ কাজে সাহায্য করেন তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র অধিদপ্তরের চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা আবুল খায়ের, যিনি ভাষণের ভিডিও ধারণ করেন। অবশ্য সে সময়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রযুক্তিবিদ এইচ এন খোন্দকার ভাষণের অডিও রেকর্ড করেন। অডিও রেকর্ডটি এম আবুল খায়েরের মালিকানাধীন রেকর্ড লেবেল ঢাকা রেকর্ড প্রকাশিত এবং আর্কাইভ করা হয়। পরবর্তীতে অডিও-ভিডিও রেকর্ডিংয়ের একটি অনুলিপি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং অডিওটির একটি অনুলিপি ভারতে পাঠানো হয়। সে সঙ্গে অডিওটির ৩০০০ অনুলিপি করে তা পুরো পৃথিবীতে ভারতীয় রেকর্ড লেবেল এইচএমভি রেকর্ডস দ্বারা বিলি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ পৃথিবীর মোট ১২টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল বা ডকুমেন্টারী হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভাষণটি সহ মোট ৭৭ টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একইসাথে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউনেস্কো পুরো পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ) ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পাকিস্তান সরকার এদেশের মানুষকে নিধন করার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১০-১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান এয়ারলাইনস তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে আমাদের দেশে জরুরিভিত্তিতে সরকারি যাত্রী পরিবহনের নামে সাদা পোশাক পরিহিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সেনা নিয়ে আসে। সে সঙ্গে গোলাবারুদ ও আক্রমণ-প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত বিবিধ অস্ত্র বোঝাই পাকিস্তানি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে থাকে। অতঃপর আসে ২৫ মার্চের কালো রাত। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনীকে বাঙালি নিধন করার কদাকার, পাশবিক সিদ্ধান্ত দিয়ে সন্ধ্যার দিকে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান। কর্মপ্রণালি অনুসারে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তথাকথিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে, যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির প্রতিবন্ধ গুঁড়িয়ে পুরাপুরি নিশ্চল করে দেওয়া। পৈশাচিক ধ্বংসলীলা চালানোর সময় ঘড়ির কাটা যে সময়ে রাত প্রায় ১টার কাটা অতিক্রম করে ২৬ মার্চে পৌঁছে, ঠিক সে সময়ে কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়।তার আগে তার যোগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। এরপর পূর্ব বাংলা রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
এদেশে অগ্নিঝরা মার্চে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয়, বঙ্গবন্ধুর আহবানে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা হয়। বালক-বৃদ্ধ-যুবক-যুবতীসহ প্রায় সকলেই অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ ন'মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বের স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মানের মাধ্যমে বাঙালি জাতির শত শত বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।
তথ্য: সংগৃৃহীত
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ।
Reviewed by সম্পাদক
on
শনিবার, মার্চ ০৭, ২০২০
Rating:
