-->

গল্প: মায়ের ইচ্ছা।


গল্প: মায়ের ইচ্ছা।
লেখা: অভিষেক গোস্বামী বাঁঁধন,(রংপুর)।

শুক্রবার বিকেলে। আমি ইজি চেয়ারে বসে আছি। হেলে দুলে মনের আনন্দে গান বলছি ---
তুমি রবে নিরবে, হৃদয়ে মম নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমায় নিশিতে নিসম.......                       
হঠাৎ বলে উঠলাম,
- বিপীন,শোনো দেখিনি এদিকে  একবার।
-জ্বী হুজুর, বলেন।
-ভালোই তো দরজার আড়ালে বসে আমার গান শুনছিলে।
-আগ্গে জ্বী না হুজুর।
-থাক আর বলতে হবে না--
-যাও দেখিনি আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আনো তো।
-জ্বী হুজুর।

১০ মিনিট পরে, বিপীন হাজির হলো চা নিয়ে তারপর আমি বললাম তোমার সম্পর্কে তো আমার কিছু জানাই হয়নি।
[৫ ই জানুয়ারী বিপীনকে আমি বাসায় এনেছি।]

r /> -জ্বী হুজুর বলেন কী শুনতে চান--
-আচ্ছা,তোমার গ্রামের বাসা কোথায়?
-আজ্ঞে হুজুর,কিশোরগঞ্জের নেপরতলি গ্রামে।
-তোমার  বাবা-মা.....??
-হুজুর আমার বাবা আমার জন্মের আগেই মাকে ছেড়ে অন্য আরেক জনকে বিয়ে করে পাশের গ্রামে সংসার করছেন। আর আমার মা তিনি তো আমার জন্মের সময়ই মারা গেছেন।
-আহা রে! তা তোর গানের প্রতি এত ঝোক কেনো?
- গ্রামের সকলে আমাকে অভাগা মনে করে, সকলে আমাকে " অভাগা " বলে ডাকে। সবাই মনে করে আমার মুখ দেখলে নাকি সারাদিন খারাপ যাবে, এই ভেবে কেউ আমার সম্মুখ হতো না। তবে আমার এক দুঃসম্পর্কের মামা ছিল, সে আমাকে গ্রামের অন্যদের তুলনায় একটু অন্যভাবে দেখতেন। বলতে গেলে তিনি আমাকে দুঃসম্পর্কের মামা হিসেবে যতটা করণীয় তার থেকে একটু বেশী ভালোবাসতেন। তিনি আমাকে বলতেন, আমার মা নাকি গান শুনতে ও বলতে খুব ভালোবাসতেন কিন্তু তার ভগ্নস্বরের গান শুনে আশেপাশের  লোকেরা হাসত আর বলত তাকে দ্বারা নাকি এসব সম্ভব নয়। তিনি তখন তাদের কথা শুনে প্রচন্ডভাবে  দুঃখ পেতেন। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতেন না তার অক্ষমতার জন্য। তিনি বার বার উপহাসিত হতেন তাদের দ্বারা। তাই তিনি তার অক্ষমতার কথা বিবেচনা করে ঐ মামাকে বলতেন " আমি যা পারি নি, তা আমি আমার ছেলেকে দিয়ে করাবো।আমি আমার ছেলেকে বড় গায়ক বানাবো এবং যারা আমাকে উপহাস করেছে তাদের শোনাবো আমার সোনার ছেলের গান।"  কিন্তু হুজুর কী আর করার, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমি যখন প্রথম পৃথিবীর বুকে জন্মালাম সেই বিশেষ মুহূর্তে আমার মা আমাকে ছেড়ে চিরকালের জন্য বিদায় নিলেন। মামার মুখে মায়ের সেই আকাঙ্ক্ষার কথা শুনে আমার মনে তীব্র ইচ্ছে যে একদিন গায়ক হব ।
- বাহ ! সে তো ভাল কথা কিন্তু তোর এ অবস্থা কেনো?
-হুজুর মায়ের মৃত্যর পর আমার নিজের বলে কেউ নেই।  ঐ মামাই ছিল একমাত্র ভরসা। ঐ মামাই আমাকে ছোট থেকে মাতৃস্নেহে বড় করেছেন।  যখন আমি ক্রমে বড় হয়ে উঠলাম, তখন মামি আর চায় না আমি ঐ বাড়িতে থাকি। তাই তিনি বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য আমার উপর নানা অত্যাচার করতে শুরু করেন এবং বাড়ি থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে মামা আমার অলক্ষ্যে দু’ফোটা চোখের পানি ফেলে বেদনায় আপ্লুত হয়ে আমাকে শহরে নিয়ে আসেন এবং এক বাড়িতে কেয়ার টেকার হিসেবে চাকুরী নিয়ে দেন। কিন্তু আমি এতই অভাগা যে,  সেখানে দু-চার দিনের মধ্যেই ও বাড়ির গৃহকতৃরা আমার উপর প্রচন্ডভাবে নির্যাতন শুরু করে দেয়। পরবর্তীতে ৩০শে ডিসেম্বর আমি সেখান থেকে পালিয়ে যাই। দু-দিন ধরে কাজ খুঁজে না পাওয়ায় উপরন্তু ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে মহাসড়কের পাশে ফুটপাতে বসে কাঁদছিলাম। হঠাৎ এক বয়স্ক  নারী আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বয়স কত হবে, ৫৫-৬০ এই রকম, পরনে তার লাল পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ি। কিছু জিজ্ঞেস না করে হঠাৎ ১০টাকার একটা নোট আমাকে দিয়ে কোথায় যে উধাও হয়ে গেলেন পরক্ষনেই আর খুঁজে পেলাম না। আমি আর কিছুই না ভেবে ছুটে গিয়ে ঐ টাকা দিয়ে দুটো রুটি কিনে তা দিয়ে দু-দিনের ক্ষুধার জ্বালা এক্কেবারে  মিটালাম। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো থাকার কোনো জায়গা খুঁজে না পেয়ে অবশেষে ফুটপাতেই এক কোণে শুয়ে পড়লাম। তবে ফুটপাতে শুয়ে একটা মজা কি, মনে হলো পুরো সড়কটাই যেন  আমার ঘর। সে এক অন্য রকম অনুভূতি! পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন হঠাৎ এক ভুনোওয়ালা মামার সাথে দেখা,  তিনি তার দোকানে আমাকে একটা কাজ দিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস পরের দিন হঠাৎ একদল পুলিশ এসে ঐ ভুনোওয়ালা মামাকে ধরে নিয়ে গেল। ঐ দিনটাও আমার আর খাওয়া হলো না। ৫ই জানুয়ারি আমি আবার প্রতিদিনের মতো কাজের  সন্ধানে বেরুলাম যাতে দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পারি। তারপর হঠাৎ আপনার সাথে দেখা হয়ে একটু ভরসা পেলুম। আপনার এখানে এসে শীতের কুয়াশা দিয়ে ঢাকা ইচ্ছাটাকে যেন আবার নতুনরূপে খুঁজে পেলাম। তাই মায়ের সেই ইচ্ছে করছে পূরণের জন্য আমি রোজ বিকেলে দরজার আড়ালে বসে আপনার গান শুনে, তা রপ্ত করতাম। হুজুর আমি কোনো দিন জন্মের পর মায়ের মুখ দেখিনি,আমি জানি মা ঐ আকাশে তারা হয়ে সর্বক্ষণিক আমাকে দেখছেন, আর অপেক্ষা করছেন কখন তার সোনার ছেলে তার সোনার স্বাদ পূরণ করে তার উপহাসিত মুখ উজ্জ্বল করবেন।'
বিপীনের কথা শুনে আমার চোখ পানিতে টলটল করতে লাগল, কিন্তু বিপীনকে তা বুঝতে না দেবার জন্য চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললাম কী বিপীন কাজে কী কোনো মন নেই, আমাকে তো ঠান্ডা চা দিয়েছো................
গল্প: মায়ের ইচ্ছা। গল্প: মায়ের ইচ্ছা। Reviewed by সম্পাদক on সোমবার, মার্চ ০৯, ২০২০ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.