-->

ভাষা আন্দোলনে নারীর ভূমিকা।



শেখ একেএম জাকারিয়া,(সুনামগঞ্জ):
১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে প্রাক্তন পূর্ববঙ্গকে নিয়ে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশে নারীর সমাজস্বীকৃত সম্মান একদিনে আসেনি। যে সম্মান পুরুষের সহযোগী হয়ে, পুরুষকে পাশাপাশি রেখে বহু বছরের যুদ্ধ ও সাধনার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। ১৯৫২ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এমন দাবির বিক্ষোভে সহসৈনিক হিসেবে পুরুষ শিক্ষার্থীদের  পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নারী শিক্ষার্থীরা। পাকিস্তানের সামরিকবাহিনী ও পুলিশের নিশানা লাগানো বন্দুকের নলকে অগ্রাহ্য করে ঢাকার রাজপথে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবির মিছিলগুলোতে নারীরা ছিলেন সম্মুখসারিতে। ভাষা আন্দোলন চলাকালীন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  নারী শিক্ষার্থীরা গোপনে ভাষার অধিকার আদায়ের বিভিন্ন স্লোগান সংযোজিত পোস্টার এঁকেছেন এবং রাতের বেলা সে পোস্টার ছাত্রদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশেপাশের অফিস-আদালত ও বাসাবাড়ির দেওয়ালগুলোতে লাগিয়েছেন জনমনে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। ৩১ জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল। ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভায় ছাত্রীদের পক্ষ থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, ‘বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে।’বিক্ষুভের শুরুর দিকে একজন ছাত্রীর মুখে এমন ভয়হীন উচ্চারণ সহযোগীদের মনে উৎসাহ জোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অতঃপর আসে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানি পুলিশের সঙ্গে নারীরাই ঠ্যালাঠেলি করে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙেন। সেসময় পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার কাজটা করেন সিলেটের  রওশন আরা বাচ্চুসহ আরও কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী। পুলিশের সঙ্গে ঠ্যালাঠেলি করার সময় পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী গুরুতর আহত হন। এরমধ্যে রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর, বোরখা শামসুন, সুফিয়া ইব্রাহীম, সুরাইয়া ডলি ও সুরাইয়া হাকিম ছিলেন। এসব আহত আন্দোলনকারীদের চিকিৎসায়  ঢাকা মেডিকেল কলেজের নারী শিক্ষার্থীরা জরুরি ও তাৎপর্যবহ ভূমিকা রাখেন। এ নারীরাই আহত আন্দোলনকারীদের চিকিৎসার খরচ যোগাড় করতে শহুরে বাসা-বাড়িতে গিয়ে চাঁদা তুলে আনেন, পুলিশের ধাওয়া খেয়ে আসা আন্দোলনকারী ছাত্রদের  নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখেন, আন্দোলনের খরচ চালাতে অনেক গৃহকর্ত্রীরা গায়ের গহনা পর্যন্ত বেচে দেন। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ায় অনেক নারীকে জেলও খাটতে হয়েছে।  আবার কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে  বহিষ্কৃত হয়েছেন। ২১ ফেব্রুয়ারি  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর নিগ্রহের প্রতিবাদে অভয়দাশ লেনে এক সভায় নেতৃত্ব দেন বেগম সুফিয়া কামাল ও নুরজাহান মুরশিদ। ধর্মঘট চচলাকালীন পোস্টার ও ব্যানার লেখার দায়িত্ব পালন করেন ড.শাফিয়া খাতুন ও নাদিরা চৌধুরী। সে সময়ের ঘটনা নিয়ে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণা, দলিল ও বইতে এর প্রমাণ মিলে। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেন, ‘১১ মার্চ ভোর বেলা থেকে শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন ভবন ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। সকাল ৮টায় পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলে কয়েকজন ছাত্রী বাধা দিতে গেয়ে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন।' তাছাড়া আত্মজীবনীতে লেখা আছে ‘ যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম, সকাল ১০টায় স্কুলের মেয়েরা (মুসলিম গার্লস স্কুল) ছাদে ওঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর ৪টায় শেষ করত। ছোট ছোট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’-এরকম বিভিন্ন ধরনের দাবি আদায়ের জন্য সমস্বরে উচ্চারিত ধ্বনি অর্থাৎ স্লোগান দিতে থাকত।
ভাষা আন্দোলন শুধু ঢাকায় নয় ঢাকার বাইরেও নারীরা এ আন্দোলন করতে গিয়ে পাকিস্তানি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নারায়ণগঞ্জের মরগান হাইস্কুলে হেড মিস্ট্রেস মমতাজ বেগম। তিনি স্থানীয়ভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে নেতৃত্ব দেন। মমতাজ বেগমের ছাত্রী ইলা বকশী, বেনু ধর ও শাবানীর মতো কিশোরীকেও পুলিশ সেদিন গ্রেপ্তার করেছিল। ১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় বাংলা ভাষার পরিপন্থি একটি লেখা প্রকাশিত হলে যশোরের হামিদা রহমান একটি নিবন্ধ লেখেন। পরে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন। এ সময় সুফিয়া খাতুন, হালিমা খাতুন নামে দু'জন নারীর নাম শোনা যায় যারা ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।  ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত  সিলেটের যে সব মহিলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে রওশনারা বাচ্চু, মুসলিম লীগের নেত্রী বেগম জুবায়দা রহিম চৌধুরী, সালেহা বেগম, ফারজানা মাহমুদ অন্যতম। এছাড়া  সিলেট মহিলা কলেজের আরও অনেক নারী শিক্ষার্থী তাদের সাথে কাজ করেছেন। সে সময়ে সিলেট থেকে পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের নিকট  প্রতিনিধিও পাঠানো হয়়। এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বেগম জোবায়দা রহিম চৌধুরী। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সাহারা বানু, সৈয়দা লুৎফুন্নেছা, রাবেয়া বেগম প্রমুখ। জানা যায়, সিলেটের কুলাউড়ার সালেহা বেগম ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালীন ভাষা শহীদদের স্মরণে নিজ স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করেন। এ খবর সেখানকার জেলা প্রশাসকের কাছে পৌঁছলে জেলা প্রশাসকের আদেশে স্কুল থেকে সালেহা বেগমকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এরপর  তাঁর আর পড়ালেখা করা হয়ে ওঠেনি। বিপ্লব ও  বিদ্রোহের অঞ্চল চট্টগ্রাম। যে কোনও সময়ে দেশ ও জাতির দরকারে চট্টগ্রামের ভূমিকা অদ্বিতীয়। ভাষা আন্দোলনেও এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। চট্টগ্রামের বেশকিছু নারী শিক্ষার্থীসহ সেখানকার প্রগতিশীল মহিলারাও বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে  তোহফাতুন্নেছা আজিম, সৈয়দা হালিমা, সুলতানা বেগম, নুরুন্নাহার জহুর, আইনুনু নাহার, আনোয়ারা মাহফুজ, তালেয়া রহমান, প্রতিভা মুৎসুদ্দি অন্যতম। ভাষা সৈনিক চেমন আরা জানান, ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যারা তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন খুলনার
আনোয়ারা খাতুন। তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন তমদ্দুন মজলিসের কর্মী সাজেদা আলী ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরা। ভাষা সৈনিক আনোয়ারা খাতুন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং বায়ান্নর ভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন।  
সাতক্ষীরায় এ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা রাখেন গুলআরা বেগম ও সুলতানা চৌধুরী। টাঙ্গাইলে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নুরুন্নাহার বেলী ও রওশন আরা শরীফ। রংপুরে এ সময় যে সব নারীরা রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন তারা হচ্ছেন নিলুফা আহমেদ, বেগম মালেকা আশরাফ, আফতাবুন্নেছা প্রমুখ।  রাজশাহীতে যারা আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ড. জাহানারা বেগম বেনু, মনোয়ারা বেগম বেনু, ডা. মহসিনা বেগম, ফিরোজা বেগম ফুনু, হাফিজা বেগম টুকু, হাসিনা বেগম ডলি, রওশন আরা, খুরশিদা বানু খুকু, আখতার বানু প্রমুখ। গাইবান্ধার বেগম দৌলতুন্নেছা ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।  তিনি ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন।  নাদেরা বেগম ও লিলি হকের নামও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এছাড়া হামিদা খাতুন, নুরজাহান মুরশিদ, আফসারী খানম, রানু মুখার্জী প্রমুখ নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ভাষা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রণে সবচেয়ে বড় অঘটন বা ক্ষতির দিন ছিল ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার অভিযোগে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ জন নারী শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে লায়লা নূর, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, রওশন আরা বেনু, ফরিদা বারি, জহরত আরা, কামরুন নাহার লাইলি, হোসনে আরা, ফরিদা আনোয়ার ও তালেয়া রহমান অন্যতম। ভাষা আন্দোলন বা তার পূর্ববর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীদের প্রক্টরের অনুমতি নিয়ে এবং প্রক্টরের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র বা অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে হতো। সে সময়ের পরিবেশ এমন দুর্বোধ্য ছিল যে, শহর কিংবা গ্রামে যে কোনও স্থানে নারীদের  পর্দা প্রথা কঠোরভাবে মেনে চলতে হতো । সমাজসম্বন্ধীয়,  ধর্মবিষয়ক, প্রতিষ্ঠানগত ও রাষ্ট্রসংক্ৰান্ত বাধা ঠেলে বাংলাভাষার দাবিতে নারীদের রাজপথে নেমে আসা খুবই দুরূহ ছিল। এতকিছুর পরেও পুরুষের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে অংশ নিতে সবচেয়ে বড়ো ঝুঁকিটাই নিয়েছে  নারীরা।
ভাষা আন্দোলনে নারীর ভূমিকা। ভাষা আন্দোলনে নারীর ভূমিকা। Reviewed by সম্পাদক on শনিবার, ফেব্রুয়ারী ২৯, ২০২০ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.