◼বইয়ের নাম: ডাকঘর ।
◼লেখক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুুর
রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ডাকঘর’। ভারতবর্ষে এবং ভারতবর্ষের বাইরে এই নাটক ব্যাপক মঞ্চসফলতা অর্জন করেছে। ডাকঘরকে ইংরেজিতে অনুদিত করার পর নাম হয়েছে ‘The Post Office’. পাঠকদের কাছেও নাটকটি তুমুল জনপ্রিয়। অথচ সার্থক নাটকের উপাদান বলতে যা যা বোঝায়—প্লট, চরিত্র, নাটকীয়তা, বস্তুধর্মিতা, সংঘাত, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি এখানে তেমনভাবে প্রবল নয়। তা সত্ত্বেও কাগজে এবং মঞ্চে এর এত জনপ্রিয়তার কারণটা আসলে কী? কী আছে এই নাটকে?
মানুষের মনের গভীর অতলে কোথাও চাপা পড়ে থাকা চঞ্চল ছটফটে এমন একটা অনুভূতি, যা থেকে থেকেই বিলাপ করে ওঠে। সেটা হচ্ছে মুক্তির আকুতি। শুধুমাত্র ঘরের চারটা দেয়াল নয়, আরও অনেক অজস্র অদৃশ্য বাঁধা মানুষকে নির্মমভাবে বন্দি করে রাখে। মানুষ মাত্রই কোনো না কোনোভাবে বন্দি। তাই মুক্তির শব্দ কানে এসে লাগতেই সে চঞ্চল হয়ে ওঠে। প্রাণটা তার তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো আঁকুপাঁকু করতে থাকে। কখনো কখনো মুক্তির তৃষ্ণায় পাগলপ্রায় হয়ে যায় কিন্তু মুক্তি নামক সোনার হরিণ তাকে ধরা দেয় না। এদিক ওদিক দিয়ে পাশ কাটিয়ে তার সেই তৃষ্ণাকে যেন আরও প্রখর করে তোলে। মুক্তির জন্য এই আকুলতা পাঠক, দর্শক এবং এই দুই শ্রেণির বাইরের প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে কোনো না কোনো রূপ নিয়ে। একেকজনের ক্ষেত্রে বন্দির কারণ যেহেতু একেকরকম, তাই মুক্তির এই রঙটাও একেকরকম। আর রবীন্দ্রনাথ যা করেছেন তা হলো মানব-মনের সুপ্ত অস্পর্শ্য এই আকাঙ্ক্ষাটিকে খুব শৈল্পিক আর সুচারুভাবে ভাষার গাঁথুনি দিয়ে এঁকে ফেলেছেন। পাঠক এবং দর্শকেরা তার এই সৃজন দেখে আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করে: আরে! এ যে আমার কথাই বলা হচ্ছে! অন্য রূপে, অন্য চরিত্রে, অন্য কাহিনীতে এ তো আমিই। এখানেই এই নাটকের সফলতা। আর এটা কে না জানে যে মানুষের স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট সকল রকমের আবেগ-অনুভূতি কত সহজে রবীন্দ্রনাথের কালির দোয়াতের সামনে এসে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে।
ডাকঘর নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখা যায় অমল নামের একটা রুগ্ন শান্তশিষ্ট অসহায় বালককে। তার চাওয়া-পাওয়া ও করুণ পরিণতি নিয়ে ডাকঘর নাটকের প্রেক্ষাপট নির্মিত হয়েছে। মাধবদত্তের স্ত্রীর গ্রাম সম্পর্কের ভাইপো হচ্ছে এই অমল। নিঃসন্তান মাধব দত্ত অমলকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু শুরু থেকেই এই বালকটি অত্যন্ত রোগা। কবিরাজের মতে বাইরের আলো হাওয়া এই বালকের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই মাধব দত্ত সবসময় অমলকে ঘরে বন্দি করে রাখে। কিন্তু বাইরের পৃথিবী প্রতিনিয়ত অমলকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অমল জানালার পাশে বসে থেকে বাইরে হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। তার সেই জানালা দিয়ে দূরের নীল আকাশ, মেঠোপথ, সেই পথ দিয়ে অনেক দূর থেকে পুঁটুলি বাঁধা লাঠি কাঁধে হেঁটে আসা পথিক, দুপুর রোদে ভাঁড় কাঁধে নিয়ে হাঁকতে হাঁকতে চলে যাওয়া দইওয়ালা, রাস্তার ছেলের দল, প্রহরী, শশী মালিনীর মেয়ে সুধা, দূরের পাহাড়—সবই যেন অমলের বন্দিজীবনকে নিবিড়ভাবে কাছে টানে। তাদেরকে সে ডেকে ডেকে থামায়। তাদের সাথে দুটো কথা বলার জন্য। তারা অমলের সাথে কথা বলে। অমল তাদের কাছে বাইরের পৃথিবীর গল্প শোনে। শুনে বিস্মিত হয়। অমল সবসময় ওই দূরের পৃথিবীতে হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। বন্দিজীবনের এক অব্যক্ত যন্ত্রণা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। সেটা সে মাধব দত্তের কাছে প্রকাশও করে।
জানালার সামনে আসা শশী মালিনীর মেয়ে সুধার সাথে অমল গল্প করতে চায়। তার সাথে গভীর বন্ধুত্ব করার আগ্রহ প্রকাশ করে। রাস্তায় ছেলের দলের খেলাধুলা দেখে সে গভীর প্রশান্তি ফিরে পায়। একসময় সে তার নিজের সমস্ত খেলনা ওই ছেলেদের বিলিয়ে দেয় এবং তাদের করুণভাবে মিনতি জানায় যেন এসব খেলনা দিয়ে তারা অমলের সামনে খেলতে থাকে। অবশেষে একদিন প্রহরীর কাছে সে রাজার ডাকঘর বসার খবর জানতে পারে। এতে যেন তার বন্দি জীবনের গ্লানি অনেকটাই কমে যায়। ওই ডাকঘরে রাজার চিঠি আসবে শুনে খুশিতে তার প্রাণ নেচে ওঠে। অমলকে বলা হয় তার নামেও রাজার চিঠি আসবে। এটা শুনে অমলের চিত্ত প্রবল উচ্ছ্বাসে উল্লাসে নেচে ওঠে৷ ঐ ডাকঘরের ডাকহরকরা হওয়ার জন্য সে ইচ্ছা প্রকাশ করে। চিঠি নিয়ে দেশ থেকে দেশ ঘুরে বেড়াবে বলে স্বপ্ন দেখে। শেষমেশ রাজার চিঠির জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করে অমল। এভাবেই অমলের অপেক্ষার মধ্য দিয়ে নাটকটি পরিণতির দিকে এগোয়।
অপেক্ষা করতে করতে অমল গুরুতর অসুস্থ হয়ে যায়। এর মধ্যে চরিত্রগুলো আসা-যাওয়া করে। কেউ তাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে, কেউবা সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আশ্বাস যোগায়। একটা সময়ে গিয়ে নাটকটির অন্তিম ক্ষণ উপস্থিত হয়। অমলেরও সময় ফুরিয়ে আসে। নাটকের একেবারে শেষে একটা বিশেষ সময়ে সেই শশী মালিনীর মেয়ে সুধা চরিত্রটি এমনভাবে প্রবেশ করে যা আরেকটা তীব্র হাহাকারের জন্ম দেয়। শেষটা হয় রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো করে। কী একটা শৈল্পিক বিষাদে আচ্ছন্ন করে দেয় সবকিছু।
‘ডাকঘর’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের কিছু কথা এখানে তুলে দিচ্ছি:
“‘ডাকঘর’ যখন লিখি তখন হঠাৎ আমার অন্তরের মধ্যে আবেগের তরঙ্গ জেগে উঠেছিল।... প্রবল একটা আবেগ এসেছিলো ভিতরে। চল চল বাইরে, যাবার আগে তোমাকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে হবে—সেখানকার মানুষের সুখদুঃখের উচ্ছ্বাসের পরিচয় পেতে হবে। সে সময় বিদ্যালয়ের কাজে বেশ ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কি হল। রাত দুটো-তিনটের সময় অন্ধকার ছাদে এসে মনটা পাখা বিস্তার করল। ... আমার মনে হচ্ছিল একটা কিছু ঘটবে, হয়তো মৃত্যু। স্টেশনে যেন তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠতে হবে সেই রকমের একটা আনন্দ আমার মনে জাগছিল। যেন এখান হতে যাচ্ছি। বেঁচে গেলুম। এমন করে যখন ডাকছেন তখন আমার দায় নেই। কোথাও যাবার ডাক ও মৃত্যুর কথা... ‘ডাকঘরে’... প্রকাশ করলুম।... মনের মধ্যে যা অব্যক্ত অথচ চঞ্চল তাকে কোনো রূপ দিতে পারলে শান্তি আসে।... এর মধ্যে গল্প নেই। এ গদ্য-লিরিক।... আমার মনের মধ্যে বিচ্ছেদের বেদনা ততটা ছিল না। চলে যাওয়ার মধ্যে যে বিচিত্র আনন্দ তা আমাকে ডাক দিয়েছিল।”
রিভিউ লিখেছেন: মিনহাজুল ইসলাম
বুক রিভিউ- ডাকঘর; একটি অসহায় বালকের করুণ উপাখ্যান।
Reviewed by সম্পাদক
on
রবিবার, জানুয়ারী ১৯, ২০২০
Rating:
