জেবা সামিহা তমা,(রংপুর):
পড়ার জগতে বর্তমান সময়ে শিশুদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় কমিকস বা গ্রাফিক্স নভেল অর্থাৎ গ্রাফিক্স উপন্যাস। গ্রাফিক্স উপন্যাস বলতে বোঝায় ছোট গল্প বা উপন্যাসের চরিত্রগুলো এবং দৃশ্যগুলো ব্যঙ্গচিত্রে আর্ট করা এবং সংলাপগুলো অক্ষরে লেখা হয়।
যখন কমিকস বা গ্রাফিক উপন্যাসগুলো পড়া হয় তখন ব্যঙ্গচিত্র বা ছবিগুলো দেখে একটা দৃশ্য কল্পনা করতে খুব সহজ হয় এবং সংলাপগুলো পড়ে তখন পুরো উপন্যাসটি উপভোগ করা যায় বা বুঝতে পারা যায়। একজন শিশুকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলা " তোমার সাধারণ উপন্যাস পড়তে বেশি ভালো লাগে নাকি কমিকস ও গ্রাফিক্স উপন্যাস পড়তে বেশি ভালো লাগে? " শিশুটি নির্দ্বিধায় এবং কোনোরকম ভাবনা চিন্তা ছাড়াই উত্তর দেয় - কমিকস ও গ্রাফিক্স উপন্যাস। কারণটা খুব সহজ শিশুরা সাধারণত কল্পনাপ্রিয় হয়। তাই স্বাভাবিকভাবে যখন সে ছবি দেখে কোনো কিছু সহজেই কল্পনা করতে পারে তখন অবশ্যই সেটি তার কাছে প্রিয় হবে। তাই বোধহয় বর্তমানে বইমেলায় শিশুদের বইগুলোতে রঙ্গিন ব্যঙ্গচিত্র বেশিই দেখা যায়।
আমি সেই শিশুটিকে আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম " কমিকস ও গ্রাফিক্স উপন্যাস কেনো ভালো লাগে? " উত্তরে সে বলেছিলো ছবি আছে তাই, ছবিগুলো দেখতে বেশি ভালো লাগে। আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম " লেখাগুলো পড়তে বেশি ভালো লাগে না? " তারপর বললো - হুম লাগে। লেখা ও ছবি দুটোই ভালো লাগে। আমার মনে হলো বাচ্চাটি আমার প্রশ্নের জোরাজুরিতে এই উত্তর দিলো। আসল ঘটনাটি হলো শিশুরা যখন প্রথম পড়ার জগতে আসে অর্থাৎ পড়ার জগতে নতুন তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের শুধু অক্ষরে ছাপা বই কখনোই ভালো লাগবে না। তাই পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করতে তাদের কমিকস বা গ্রাফিক্স উপন্যাস পড়তে দেয়া হয়। কমিকস বা গ্রাফিক্স উপন্যাস পড়ার ফলে কিছুটা হলেও শিশুটির পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মায় এবং সে পরবর্তীতে ছাপা অক্ষরের বইও পড়তে চায়। অবশ্য ব্যতিক্রম থাকতে পারে কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না। এক্ষেত্রে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। শিশুদের পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্যে কমিকস ও গ্রাফিক্স উপন্যাস পড়তে দেয়া হলেও অনেকে এর প্রতি আসক্ত হয়ে যান এবং পরবর্তীতে ছাপা অক্ষরে বই পড়তে ইচ্ছা প্রকাশ করেন না। এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশ-বিদেশের অনেক বাবা-মা। প্যারেন্টস.কম এর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, উত্তর ক্যারোলিনের এক বই দোকানের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার অ্যাম্বার ব্রাউন বলেছেন - " যে দোকানের বই বিক্রেতারা প্রায়শই গ্রাফিক উপন্যাসগুলোর প্রতি বাচ্চাদের ভালবাসার বিষয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের উদ্বেগকে সহজ করে দেখেন। পিতামাতারা উদ্বিগ্ন এই নিয়ে যে বাচ্চারা সাধারণ বই পড়ার ক্ষেত্রে দক্ষতা বিকাশ করবে না। আসলে উল্টোটাই। সত্য হলো যেসব বাচ্চারা গ্রাফিক উপন্যাসগুলি পড়ে তারা পড়ার প্রতি ভালবাসার বিকাশ ঘটাতে পারে। তবে স্বার্থক শিক্ষার্থীরা ছবি ভর্তি বইগুলোর নেশা থেকে বেরিয়ে এসে অন্যান্য বই পড়তে সক্ষম হয়। "
বাবা-মা এবং শিক্ষকদের কাছে মনে হতে পারে যে বাচ্চারা গ্রাফিক্স উপন্যাসে বেশি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কলেজের রিডিং অ্যান্ড রাইটিং প্রজেক্টের সিনিয়র স্টাফ ডেভেলপার শানা ফ্রেজিন বলেছেন " যে বাচ্চাদের বা শিক্ষার্থীদের আগ্রহ গবেষণায় জড়িত হওয়া দরকার ( কল্পনায় নয় )। "
তবে আমার মনে হয় যেসব কাজে কল্পনাপ্রবণ দক্ষতার প্রয়োজন হয় সেসব কাজের জন্যে হলেও গ্রাফিক্স উপন্যাস পড়ে কল্পনা শক্তি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
গ্রাফিক্স উপন্যাস ও কমিকস নিঃসন্দেহে একজন মানুষের কল্পনা শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। এমনকি কল্পনা শক্তি বৃদ্ধিতে এর থেকে ভালো উপায়ও বোধহয় আর হয় না।তবে কিছু বিশেষজ্ঞের আবার ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তারা মনে করেন বাচ্চারা গ্রাফিক্স উপন্যাস পড়ে যখন বেশি কল্পনাপ্রবণ হয় বা কল্পনায় রাজ্যে বসবাস শুরু করলে তারা বাস্তবেও উপন্যাসের প্লটগুলোকে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন। যা সবসময় ঠিক নয়। উদাহরণসরূপ কোনো এক গ্রাফিক্স উপন্যাসের প্লট হলো নায়ক ও খলনায়কের মধ্যে কোনো মহৎ কাজের জন্যে প্রচুর মারামারি হয়। এখন উপন্যাসের কোনো চরিত্র কোনো শিশুর ভীষণ ভালো লেগে যায় এবং সে কল্পনা রাজ্যে থেকে বাস্তবেও যুদ্ধ করতে চায় এবং অনেক সময় খেলার ছলে মারামারি করে। এতে মাঝেমধ্যে শিশুদের ক্ষতি হতে পারে তাই অনেক বিশেষজ্ঞ গ্রাফিক্স উপন্যাস পড়ার এই প্রভাবকে নেতিবাচক বলছেন এবং একারণেই অনেকে গ্রাফিক্স উপন্যাস পড়ার বিরুদ্ধে। জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও গ্রাফিক্স উপন্যাসগুলি দীর্ঘকাল একটি কলঙ্ক বহন করে। ১৯৫৪ সালে সেসময়ের বহুল পঠিত বই 'সিডাকশন অফ দ্য ইনোসেন্ট' দ্বারা কলঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে লেখক ফ্রেড্রিক ওয়ার্থাম বিশদ প্রমাণ করেছেন যে কমিক্স পড়লে কিশোর অপরাধের কারণ হয়।
অরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে কমিকের বইগুলির গড় প্রতি হাজারে ৫৩.৫ বিরল বা আরও জটিল শব্দ রয়েছে। এটি বাচ্চাদের বইয়ের চেয়ে বেশি যা গড়ে ৩০.৯ এবং এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের বই ৫২.২। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে গ্রাফিক্স পাঠ্যগুলি শিক্ষার উন্নতি করে এবং আরও ভাল পুনরুদ্ধার করে। অন্যটি দেখা যায় যে শিক্ষার্থীরা গ্রাফিক্স উপন্যাসগুলো পড়ার সময় সর্বাধিক পড়া অনুধাবন করেছিল এবং সর্বাধিক পড়া উপভোগ করেছিল। তারা অনিচ্ছুক পাঠকদের একটি বই পাঠক হিসেবে গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে। ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডিং এডুকেশন প্রোগ্রামের পরিচালক এমিলি পেন্ডারগ্রাস বলেছেন - " মানুষ কি পড়ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে তারা কীভাবে পড়ছে এবং কতবার তারা পড়েন এটি তাদের সাক্ষরতার উন্নতি করে। "
" স্বরে অ তে অজগর " শুধু এটা বলে যদি একজন শিশুকে আপনি শেখাতে যান তাহলে আপনাকে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। যেমন সে পড়তেই চাইবে না অথবা পড়লেও সহজে মনে রাখতে পারবে না। কিন্তু আপনি যখন অজগর সাপের ছবি দেখিয়ে স্বরে অ তে অজগর পড়াবেন তখন শিশুটি পড়তে বেশি আগ্রহ দেখাবে এবং সে পড়াটি সহজে মনে রাখতে পারবে। টেলজিমিয়ার গ্রাফিক্স উপন্যাস পড়া নিয়ে বলেছেন,
" গ্রাফিক্স উপন্যাস পড়ার সময় বাচ্চারা প্রথমে পড়ার গতি বাড়াবে এবং তারপরে সেগুলি বার বার পড়বে। প্রথমে বাচ্চারা গল্পটির মূল পয়েন্টগুলো ক্যাপচার করছে এবং তারপরে এটি আবার পড়লে বইয়ের পড়ার সমস্ত ঘনত্বগুলিতে ডুব দিচ্ছে। এটি পাঠককে সত্যিই চালকের আসনে রাখে। তাদের কাজটি করতে হবে। তাদের দেখতে হবে, ভাবতে হবে, অবাক হতে হবে এবং সূত্রগুলো খুঁজতে হবে এবং পুরো গল্পটি বুঝতে একটি ভিজ্যুয়াল গোয়েন্দা হয়ে উঠতে হবে।"
সবকিছুরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকবে। সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করতে পারলে নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করা সম্ভব। কমিকস ও গ্রাফিক্স উপন্যাসের জনপ্রিয়তার মাধ্যমে আমরা তা দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অর্থাৎ শিশুদের সঠিক ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে পারি।
তথ্য সূত্র: প্যারেন্টস.কম
কমিকস বা গ্রাফিক্স উপন্যাস কি সত্যিই শিশুদের পাঠভ্যাস তৈরী করে?
Reviewed by সম্পাদক
on
বুধবার, জুন ০৩, ২০২০
Rating:
