-->

রহস্যময় সিন্ধু সভ্যতা;প্রাচীন পৃথিবীর মাঝে আধুনিক নগর সভ্যতা।


সাজ্জাদুল ইসলাম রাকিব,(নোয়াখালী):
অনেকদিন থেকেই প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মনে করছিলেন সিন্ধু নদের তীরে মাটির নীচে হয়তো লুকিয়ে আছে কোন প্রাচীন সভ্যতা। তাই তাঁরা অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯২১ সালে হরপ্পা অঞ্চলে প্রথম উৎখনন করা হয়। হরপ্পা অবস্থিত পশ্চিম পাঞ্জাবের মন্টোগোমারী জেলার ইরাবতী নদীর পূর্ব উপকূলে। পরের বছর উৎখনন করা হয় মোহেনজো-দারো অঞ্চলে। বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে এর অবস্থান। সিন্ধুর লারকানা জেলার খয়েরপুরে মোহেনজো-দারো অবস্থিত। এরপর প্রায় প্রতি বছরই খনন কাজ চলতে থাকে। আর বেরিয়ে আসতে থাকে সভ্যতার চমৎকার সব নিদর্শন।

এভাবে নতুন নতুন অঞ্চলে পাওয়া নিদর্শন প্রমাণ করতে থাকে যে, সিন্ধু সভ্যতা শুধু হরপ্পা আর মোহেনজো-দারোকে ঘিরেই গড়ে ওঠেনি। অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল এই নগর। সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া স্থাপত্য, নজরকাড়া মূর্তি, মাটির পাত্র, অলঙ্কার সব কিছু বলে দেয় কত বুদ্ধিমান ছিল সে যুগের মানুষ। হরপ্পা এবং মোহেনজো-দারো নগরী আবিষ্কারের পথ ধরেই প্রাচীন ভারতের নতুন নতুন সভ্যতার সাথে পরিচয় ঘটে মানুষের।

এই সভ্যতা ছিল তাম্র-ব্রোঞ্জ (ক্যালকোলিথিক) যুগের সভ্যতা। কারণ, লোহার ব্যবহার এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অজ্ঞাতই ছিল। এই সভ্যতার সামগ্রিক সময়কাল ধরা হয় ৫৫০০-১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সিন্ধুবাসীদের প্রধান কৃষিজ ফসল ছিল গম, যব, মটর, খেজুর, তিল ও সরষে। সভ্যতার অনেক আগেই কৃষির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল।

ভারত বিভাগের পর সিন্ধু সভ্যতার অধিকাংশ প্রত্নস্থল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত হয়। উল্লেখ্য, পাকিস্তান ভূখণ্ডই ছিল এই প্রাচীন সভ্যতার মূল কেন্দ্র। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান সরকারের পুরাতাত্ত্বিক উপদেষ্টা স্যার মর্টিমার হুইলার এই সব অঞ্চলে খননকার্য চালান। সিন্ধু সভ্যতার সীমান্তবর্তী প্রত্নস্থলগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে পশ্চিমে বালোচিস্তানের সুকতাগান ডোর এবং উত্তরে আফগানিস্তানের আমুদারিয়া বা অক্সাস নদীর তীরে শোর্তুগাই অঞ্চলে।

সিন্ধু সভ্যতার মোট আয়তন প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার ৷ সমগ্র উত্তর পশ্চিম ভারত জুড়ে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটে ৷ ভৌগোলিক বিস্তারের বিবেচনায় সিন্ধু সভ্যতা ছিল প্রাচীন পৃথিবীর বৃহত্তম সভ্যতা। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ ছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণ বেলুচিস্তানে এ সভ্যতার অস্তিত্ব লক্ষণীয় ৷ প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার চেয়ে এই সভ্যতা ছিল প্রায় ২০ গুণ এবং প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মিলিত এলাকার তুলনায় ছিল ১২ গুণ বড়৷ 

ওজন করার নানান সামগ্রী মূলত সিন্ধু সভ্যতাতেই আবিষ্কৃত হয়েছে ৷ ওজনের জন্য নানা ধরনের বাটখারা ব্যবহৃত হতো ৷ ছোট বাটখারা ছিল চারকোণা এবং বড়গুলো গোলাকার৷ তবে তারা দৈর্ঘ্য মাপার জন্য স্কেলের মত লাঠি ব্যবহার করত ৷ তাদের ওজন ছিল ১৬ ভিত্তিক ৷ যেমন- ১৬, ৬৪, ১৬০, ৩২০, ৬৪০ ৷ কয়েকটি দাঁড়িপাল্লার ভগ্নাবশেষও পাওয়া গিয়েছে ৷ 

ভারত এবং পাকিস্তানের কিছু অঞ্চলে অতীতে সিন্ধু সভ্যতার পত্তন হয়। এটা ছিল এমন একটি বাণিজ্যভিত্তিক সভ্যতা যার মাঝে মিশ্রন ঘটে অনেক ভাষাভাষী সংস্কৃতির। আর এটা এমন একটা সংস্কৃতি যেখানে কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন ছিলো না। এই সভ্যতার অনেক বৈশিষ্ট্য এখনও রয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অঞ্চলে আর অতীত ও বর্তমানের মাঝে এই যোগসূত্র সব সময়েই উৎসাহী করে এসেছে গবেষকদের। এই সভ্যতার ব্যাপারে একেবারে আনকোরা তথ্য উঠে এসেছে জাপানের কিয়োটোর Research Institute for Humanity and Nature এর গবেষণা থেকে। ৫ বছর ধরে বিভিন্ন দেশের ৪০ গবেষকের প্রচেষ্টার ফসল হলো এসব তথ্য। Kyoto University Press এর অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় "Indus: Exploring the Fundamental World of South Asia" এবং "The Riddle of the Indus Civilization," নামের দুই গবেষণাপত্র। দুইটিই তৈরি করেন গবেষণার নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক তোশিকি ওসাদা। ভারতে অবস্থিত সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন এলাকায় এই গবেষণার আওতায় সর্বপ্রথম খননকার্য চালানো হয়। সিন্ধু সভ্যতার পরিচিত যে দুইটি এলাকা আছে সেগুলো হলো হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো, দুইটিই পাকিস্তানে অবস্থিত। সব মিলিয়ে রয়েছে পাঁচটি এলাকা যেখানে গবেষকরা বেশী মনোযোগ দেন। প্রথম দুইটি ছাড়া বাকিগুলো হলো পাকিস্তানের মরু অঞ্চল গানেরিওয়ালা, ভারতের ধোলাভিরা এবং রাখিগড়ি।

সিন্ধুসভ্যতার ধর্মীয় জীবনঃ সিলমোহরে খোদিত মুর্তি থেকে সিন্ধু জনগণের ধর্মজীবনের আভাস পাওয়া যায়। সিন্ধুজনগণের মধ্যে মাতৃপূজার প্রচলন ছিল। তা ছাড়া যোগাসনে ধ্যানমগ্ন পশুপরিবেষ্টিত তিনমুখবিশিষ্ট একটি পুরুষ দেবমূর্তিও পাওয়া গেছে। এই মুর্তির সঙ্গে শিবের সাদৃশ্য আছে, তাই মার্টিমার হুইলার এই দেবতাকে শিবের পূর্ব সংস্করণ বলে মনে করেন। কয়েকটি শিব লিঙ্গের আবিষ্কার এই অনুমানকে জোরদার করেছে। মূর্তিপূজা ছাড়া শক্তির আরাধ্যরূপে পাথর, গাছ ও জীবজন্তুর পূজাও প্রচলিত ছিল। তবে কোথাও মন্দিরের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি।

সিন্ধুসভ্যতার ব্যবসাবাণিজ্যঃ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল তাদের উপজীবিকা। মাল পরিবহণের জন্য দু-চাকার গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। স্থল ও জল উভয় পথেই ব্যবসা চলত। লোথালে একটি পোতাশ্রয় ছিল। হরপ্পার সঙ্গে মেসোপটেমিয়ার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল। জলপথে নৌকা ব্যবহার করা হত। তামা, ময়ূর, হাতির দাঁত, চিরুনি, বস্ত্র প্রভৃতি ছিল প্রধান রপ্তানি দ্রব্য। আমদানি হত রুপো ও অন্যান্য ধাতু। সিলমোহর গুলি সম্ভবত বাণিজ্যের কাজে ব্যবহৃত হত। তবে সিন্ধু জনগণ মুদ্রার ব্যবহার জানত না। সম্ভবত বিনিময় প্রথার মাধ্যমে কেনাবেচা হত।

সিন্ধু উপত্যকায় মানুষেরা অস্ত্রের চেয়ে যন্ত্রপাতি বেশি ব্যবহার করতো বলে মনে হয়। ছুরি, কুঠার, তীর-ধনুক, বর্শা, গুলতি ছাড়া তেমন কোনো অস্ত্রের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। আর পাওয়া গেছে কাস্তে, বাটালি, করাত, জুতা সেলাই করার সুই ইত্যাদি। ঢাল, তলোয়ার, বর্ম ইত্যাদি সামরিক অস্ত্রের নিদর্শন নেই। নেই কোনো অস্ত্রাগারের চিহ্নও। কারণ তারা এসবের প্রয়োজন অনুভব করেনি। তারা ছিল শান্তিপ্রিয়। প্রতিবেশীদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল বলে মনে হয়। এই উপত্যকাবাসীদের সঙ্গে মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, ইরান, দক্ষিণ-ভারত, রাজস্থান, গুজরাট ও বালুচিস্তানের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। মেসোপটেমিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক থাকার নিদর্শন রয়েছে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি ‘নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখীন করে দেয়া’ সিন্ধুসভ্যতার মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। উদার লোকসংস্কৃতির চর্চার ফলেই এই অসাধ্য কাজটি করতে পেরেছিল। তাই তাদের শিল্পকলাচর্চাও কর্তার ইচ্ছায় কর্মের বেড়াজাল থেকে বের হতে পেরেছে এবং সম্ভবত প্রথমবারের মতো শিল্পী আপন মনে শিল্পকর্ম তৈরির সুযোগ পেয়েছিল। অন্তত সিন্ধুসভ্যতার ছোট ছোট মাটির পুতুল, তৈজসপত্র ও খেলনাগুলো আমাদের এভাবে ভাবতে অনুপ্রাণিত করে।


সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণঃ সিন্ধু সভ্যতা কেন ও কীভাবে ধ্বংশ হয়েছিল তা আমাদের কাছে অজ্ঞাত। সম্ভবত সর্বত্র একই সঙ্গে বা একই কারণে পতন ঘটেনি।  খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ সালের দিকে সিন্ধু সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা আর্যদের আক্রমণে এই সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমান পাকিস্তানের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ, ভারতের পশ্চিমদিকের রাজ্যগুলি, দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তান এবং ইরানের বালোচিস্তান প্রদেশের পূর্ব অংশ এই সভ্যতার অন্তর্গত ছিল।

(১) কারও মতে, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব মহেন-জো-দরো শহরের পতন ডেকে এনে ছিল।

(২) অনেকের মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যা । মার্শাল, ম্যাকে, রেইক্স, ডেল্‌স প্রভৃতিরা মনে করেন বন্যাই এই সভ্যতার পতনের কারণ।

(৩) অনেকে আবার মনে করেন বন্যা নয়, অনাবৃষ্টির জন্যই এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। বৃষ্টিপাতের তারতম্য ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদন বলে অনেকে মনে করেন।
রহস্যময় সিন্ধু সভ্যতা;প্রাচীন পৃথিবীর মাঝে আধুনিক নগর সভ্যতা। রহস্যময় সিন্ধু সভ্যতা;প্রাচীন পৃথিবীর মাঝে আধুনিক নগর সভ্যতা। Reviewed by সম্পাদক on বৃহস্পতিবার, মে ২৮, ২০২০ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.