গল্প: মায়ের জন্য।
লেখা: সাইফুল ইসলাম জুয়েল।
আকাশের আজ মন ভালো নেই। চারিদিকে এত এত লাশের গন্ধে কারই বা মনটা ভালো থাকে। কতই বা বয়স তার। বারো বছরের একজন কিশোর বালক। শিশু সুলভ চপলতা এখনো যায়নি। খাল পাড়ের আলপথ দিয়ে মৃদু গতিতে দৌড়াচ্ছে সে। একটু আগে খালের ওপারে বাজারের কাছাকাছি এলাকা থেকে দু-তিন রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা গেছে। ইস্, এই বুঝি আরো কয়েকজনকে মেরে ফেললো পাষ-গুলো। এতক্ষণ সে খালে ভেসে আসা লাশগুলোকে দেখে চেনার চেষ্টা করছিল। এবারে সে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যার আগেই তিনগ্রাম পরের বাজনাতলায় যেতে হবে। কমন্ডার আব্বসের দেখা না পেলে সবকিছুই মাটি হয়ে যাবে।পাষণ্ডগুলো কী নিষ্ঠুর ভাবেই না তার চাচা-চাচীকে মেরে ফেললো! ঘটনাটা মনে পড়তেই মাথাটা ঝিম ঝিম করে আকাশের। জীবনে কখনো কোনো মৃত্যু দেখেনি সে। আসল কথা হল- তার মা তাকে এমন ভাবে আগলে রেখেছেন যে- আকাশ ইচ্ছা করলেও মায়ের কারণে সে কখনো দূর কোথাও যেতে পারেনি। একবার মাকে কিছু না বলে পাশের গ্রামে টোকি দেখতে গিয়েছিল। ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। বাসায় এসে দেখে - তার মায়ের সে কী কান্নাকাটি! আকাশকে দেখা মাত্রই তাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে-মুখে হাজারবার চুমো খেলেন তিনি। সেই মা-ই আজ আকাশকে তিনগ্রাম দূরের অচেনা গন্তব্যে পাঠাচ্ছেন! প্রথমে সে আসতে চায়নি। মা আকাশকে বুঝিয়েছেন, বাবা-মা করোরই চিরকাল বেঁচে থাকেন না। কিন্তু এমন একটা সম্পদ আছে যেটা চিরকাল টিকে থাকে। সকলের প্রিয় সেই সম্পদটা মানুষকে সবসময় পরম মমতায় আগলে রাখে। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থলও সেটি। এক প্রকারের নিম রাজি হয়েই অনিশ্চয়তার মাঝে আকাশ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। এতদূর আসার পরে আর একটি কথা মনে উঠল তার- তার মতো একটি ছোট ছেলেকে কমান্ডার আব্বাস দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবেন না তো? তাহলে যে তার মায়ের ইচ্ছাটা সে পূরণ করতে পারবে না। মা অবশ্য বলেছিলেন- যেভাবেই হোক তাদের সাথে থেকে যেতে। তারা যতদিন থাকবে, ততদিন সে যেন বাড়িতে না আসে। প্রয়োজনে তাদের পানি টেনে দিবে, খাবারগুলো এগিয়ে দেবে। মোট কথা- যেভাবেই হোক তাকে কমান্ডারদের সাথে যেতেই হবে।
সন্ধ্যার মধ্যে বাজনাতলা না যেতে পারলে আব্বাসকে পাওয়া যাবে না। কতদূর যেতেইে তার মনে হল- রহিমটা যদি তার সাথে যেত! দু জনে পাশাপাশি থাকতে পারতো। অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই তার মনে পড়ে- রহিমকে কাল রাতে হানাদাররা নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলেছে। তার মাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য এসেছিল পশুগুলো। ছোট রহিম মাকে বাঁচাতে ছুরি নিয়ে একটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। কিন্তু লোকটা ঠিক সময়ে সরে গিয়ে তাকে দুহাতে ঝাপটে ধরে। তার দিকে বন্দুক তাক করা মাত্রই রহিমের মায়ের সে কী আহাজারি! শেষে সন্তানকে বাঁচাতে নিজে বুলেটের মুখে দাঁড়িয়ে পড়েন। হানাদাররা মা-ছেলে দুজনকেই মেরে শিয়াল-কুকুর দিয়ে খাওয়ানোর জন্য ফেলে রেখে যায়। আবারো থমকে দাঁড়ায় আকাশ। দৌড়াতে গিয়ে প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে। সূর্যটা ইতিমধ্যে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। আশে পাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই। গ্রামের মূল পথটা এখান থেকে খুব কাছাকাছি। হঠাৎ একটা ভ্যান গাড়ি আসতে দেখে থমকে দাঁড়ায়। হানাদাররা নয় তো? একটা গাছের আড়ালে লুকোয় সে। সাবধানে দেখে- হানাদার নয়, তাদের গ্রামের মাখনরা সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছে। মাখনকে দেখে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে আকাশ। তাকে দেখে মাখন ছুটে আসে। মাখন ইতস্তত জানায়, ‘তোর মাকে দুপুরে হানাদাররা মেরে ফেলেছে।’
কথাটা শোনা মাত্রই আকাশ বাজনাতলার দিকে আরো জোড়ে ছুটে। কমান্ডার আব্বাসের দেখা পেতেই হবে। এবারে আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের কিছু নেই। নেই কোনো পিছু টান। মায়ের জন্য তাকে সবকিছু করতে হবে!
এক সময় কমান্ডার আব্বাসের দেখা মেলে। তারা রাতের অভিযানে বের হচ্ছেন। দেখা হওয়া মাত্রই আকাশ কমান্ডারকে বলে, ‘আমি আপনাদের সাথে যাবো।’
‘না, তোর মতো বাচ্চা ছেলের যুদ্ধ করার দরকার নেই। আমরা তো আছিই।’
‘না, আমাকে যেতেই হবে। আমার মাকে বাঁচাতে হবে। প্রয়োজনে মায়ের জন্য জীবন দিব।’
‘কেন তোর মাকে কী পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গেছে?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘এই বাংলাই আমার মা। আমি আমার এই মাকে মুক্ত করতে এসেছি।’
কমান্ডার আব্বাস ক্ষণিকের জন্য থ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আকাশের সব কথা শোনেন তিনি। তারপর আকাশের পিঠ চাপড়ে বলেন, ‘তুই হলি গিয়ে আমাদের কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা। তোরাই এই বাংলা মায়ের যোগ্য সন্তান। মা কারোরই চিরকাল বেঁচে থাকেন না। কিন্তু এই বাংলা আমাদের চিরঅমর মা। এই মায়ের জন্য আমরা লড়ব। চল, তাহলে বেরিয়ে পড়ি...।’
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী
গল্প: মায়ের জন্য - একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্প।
Reviewed by সম্পাদক
on
বুধবার, জানুয়ারী ২৯, ২০২০
Rating:
