-->

আমার চাকুরিতে যোগদান ও একুশে ফেব্রুয়ারি : শফিয়ার রহমান।




বিশেষ প্রতিবেদন:

উচ্চ শিক্ষার পুরো সময়টি সামরিক জান্তা বিরোধী আন্দোলন করেছি ৷ আন্দোলন করতে গিয়ে সেশন জটে চার বছরের শিক্ষা সমাপ্ত হয় আট বছরে ৷ ফলে শিক্ষা গ্রহন শেষ না হতেই সরকারি চাকুরীর আবেদনের বয়সসীমা অতিক্রম করে ৷ ফলে সরকারি চাকুরীর জন্য আর কোনো টেনশন ছিল না ৷ সামরিক জান্তার পতন না হওয়া পর্যন্ত  রাজপথে থেকে স্বৈরাচারের পতনে সক্রিয় ছিলাম ৷ পতনের পর  সরকারি চাকুরীতে প্রবেশের বয়সসীমা ত্রিশ বছর হয় ৷ এসময় আমার বয়স ত্রিশ বছর ছুই ছুই করছে ৷ আবেদন করার সুযোগ পেলাম৷ আবেদন করলাম এবং নির্বাচিত হলাম ৷ সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়ে চুয়াডাংগা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করলাম ৷ প্রথম শহীদ দিবসে দেখলাম বিদ্যালয় বন্ধ ৷ মন খারাপ ৷সদ্য আন্দোলন থেকে ফেরার টগবগে রক্ত কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে নাই ৷ দ্বিতীয় বছর অনেক ছাত্রীর সাথে কথা বললাম ৷ তারা শহীদ দিবসে ফুল দেয় কি না ৷অনেকেই পারিবারিক ভাবে ফুল দেয় ৷
  প্রধান শিক্ষিকা মহোদয়কে শহীদ দিবস পালন করতে বলার মত সাহস করতে পারলাম না ৷ কয়েকজন ছাত্রীর সাথে কথা বলে ঠিক করলাম তারা শহীদ দিবসে স্কুলে আসবে এবং আমরা  একসাথে চুয়াডাংগা কলেজের শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাব ৷আমি ২০ ফেব্রুয়ারি বিকাল বেলা কামিনি ফুলের পাতা ও গাঁদা ফুল সংগ্রহ করে নিজ হাতে একটি মালা তৈরি করলাম ৷ তৈরি করতে অনেক সময় লেগেছে এবং কষ্ট হয়েছে ৷  একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা ৩০- ৩৫ জন ছাত্রী উপস্থিত হলো ৷ তাদের সাথে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে মিছিল করে চুয়াডাংগা সরকারি কলেজের শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই ৷  সকলে বিদ্যালয়ে ফিরে আসলাম ৷এ কর্মসুচীতে অংশগ্রহন করে ছাত্রীরা খুব খুশী ৷ আমারও খুব আনন্দ হচ্ছিল ৷ পাশাপাশি মনের মধ্যে আতংকও ছিল ৷ প্রধান শিক্ষিকা আমাদের এই কর্মকান্ডকে ভালো চোখে দেখবে কি না ৷ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অনেক সিনিয়র  শিক্ষক শিক্ষিকার সাথে কথা বলেছি ৷ অনেকেই ইতিবাচক মনে করেন নাই ৷ তাঁরা মনে করেন ছুটির দিনে ছুটি ভোগ করা যাবে না ৷ ছুটির দিনে বিদ্যালয়ে আসব কেন ? আশার দিক হলো শহীদ দিবস পালনে একজন সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মোখতার আলী স্যার আমাকে উৎসাহিত করেন ৷ তিনিও শহীদ দিবসের র‍্যালিতে আমাদের সাথে থাকার আশ্বাস দেন ৷ তাঁর আশ্বাস আমার কাছে প্রেরনা ও সাহস যুগিয়েছিল ৷ তাঁর উপস্থিতিতে দ্বিধা দ্বন্দ কেটে সফলভাবে শহীদ দিবস পালন করি ৷ এই আয়োজনের জন্য দুইটি সুতার গুটি কেনা ছাড়া আর কোনো ব্যয় করতে হয় নাই ৷ সুতার গুটি কিনতে দুই টাকা লেগেছিল ৷ এজন্য যেটির বেশি প্রয়োজন সময় , পরিশ্রম ও সদিচ্ছা ৷ কর্মসুচী শেষে মোখতার আলী স্যার বলেছিলেন,"শফিয়ার  সাহেব, আপনি আজ হোক বা কাল হোক বদলি হয়ে চলে যাবেন , এ দায়িত্ব আমাদের চালিয়ে যেতে হবে ৷"  স্যার সত্যিই একটি সত্য কথা বলেছিলেন ৷
‌  ২২ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ে আসলাম ৷ প্রধান  শিক্ষিকা ইলা হক আমাকে ডেকে পাঠালেন ৷ একটু ভয়ও করছে আবার সাহসও হচ্ছে তিনি আমাকে খুব ভালো বাসতেন ৷ আমাকে নিজ ছেলের মত মনে করতেন ৷তাঁর কক্ষে গিয়ে বসলাম৷ কিন্তু তিনি যা বললেন তা শুনে নিজেকে অপরাধী মনে হলো ৷ তিনি বললেন, "আমাকে বললে সব ব্যবস্থা করে দিতাম ৷ আমিও থাকতাম ৷ আগামীতে বিদ্যালয়ের  ব্যবস্থাপনায় দিবসটি পালন করব ৷ আপনাকে ধন্যবাদ ৷ "
‌   বছর ঘুরে আবার এলো ফেব্রুয়ারি মাস ৷প্রধান শিক্ষিকা আমাকে ও বাবু শিশির কুমার মজুমদার স্যার কে ডেকে বললেন  সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর আয়োজনের ব্যবস্থা করে শহীদ দিবস পালন করতে ৷ শিশির দা হলেন খুলনা বেতার কেন্দ্রের উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিল্পী ৷ শহীদ দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এর জন্য স্যার বিদ্যালয়ের শিল্পীদের নিয়ে রিহার্সেল শুরু  করলেন ৷ শহীদ দিবসে বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক শিক্ষিকা, ছাত্রী, কর্মচারী মিলে মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ পালন করলাম ৷
  বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষিকা আমাকে ধন্যবাদ দিলেন ৷ কয়েকজনের  একটু মন খারাপ হয়েছিল ছুটির দিনে ছুটি ভোগ করতে না পারার জন্য ৷ তাঁরা হাসতে হাসতে মিষ্টি ভাষায়  ছুটি ভোগ করতে না পারার জন্য আমাকে দায়ি করলেন৷ কিন্তু আমি খুশিই হয়েছি ৷  ছয় বছরের বেশি সময় ঐ বিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলাম , শহীদ দিবস পালনের ধারাবাহিকতার কমতি হয় নাই ৷
আমি চেষ্টা করেও একজন ছাত্রীর নাম মনে করতে পারলাম না ৷ যারা শ্রদ্ধার্ঘ অর্পন করার জন্য শুরুর দিন সহযোগিতা করেছিল ৷ আজকের এই দিনে তাদেরকে ধন্যবাদ ৷
ভালো কিছু করতে কোনো বাধাই বাধা থাকে না ৷ আবার অনেক সময় বাধা আসতে পারে  এই আশংকায় মহৎ কিছু করার উদ্যোগ নিতে ভয় পেলেও শুরু করলে দেখা যায় , ভয়ের ব্যক্তিই সবচেয়ে আন্তরিক ৷ বাহ্যিক দেখে  সিদ্ধান্ত নয়, অন্তরের  ভাবনা জানার জন্য কাজ শুরু করতে হয় ৷ উদ্দেশ্য ভালো হলে সফলতার দ্বারে পৌঁছে দেয়ার লোকের অভাব হয় না ৷ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেয়ার সাহসী লোকের অভাব হয় ৷ মহৎ  উদ্দেশ্যে ভালো কিছুর উদ্যোগ , অবশ্যই ভালো ফল দেয়৷

-শফিয়ার রহমান
সহকারী শিক্ষক ,
রংপুর জিলা স্কুল,রংপুর।
আমার চাকুরিতে যোগদান ও একুশে ফেব্রুয়ারি : শফিয়ার রহমান। আমার চাকুরিতে যোগদান ও একুশে ফেব্রুয়ারি : শফিয়ার রহমান। Reviewed by সম্পাদক on বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ২৮, ২০১৯ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.