-->

একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমার ছেলেবেলা : শফিয়ার রহমান।




বিশেষ প্রতিবেদক:

গ্রামের একটি স্কুলে লেখাপড়া করেছি৷ একই স্কুলের মাঠে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় অবস্থিত ৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পারুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নাম পারুলিয়া তফশিলি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ,হাতীবান্ধা, রংপুর ৷ এখন ঠিকানা হাতীবান্ধা , লালমনিরহাট ৷ আমাদের তখন মহকুমা ছিল রংপুর এবং জেলাও ছিল রংপুর ৷
প্রাথমিক থেকে এস এস সি পাস করা পর্যন্ত ঐ গ্রামেই শহীদ দিবস পালন করেছি ৷ এই দিনটিতে দুই ধরনের কর্মসুচী দুই প্রতিষ্ঠান এর মাধ্যমে পালন করেছি ৷ একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের বিদ্যালয় অপরটি শাপলা শালুক খেলাঘর ৷ শাপলা শালুক খেলাঘর নামের এই শিশু সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ওসমান গণি বাদশা,ছাইয়াকুল ইসলাম,বাবলু দা( ভালো নাম জানি না) ছায়েদুল ইসলাম রবি ৷ এছাড়াও অনেকেই সহযোগিতা করেছিলেন ৷ প্রথম দুইজন পরবর্তীতে ইউ পি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন ৷ তৃতীয় জন সপরিবারে ভারতে আছেন ৷ চতুর্থ জন সরকারি চাকুরি করেছেন ৷
শাপলা শালুক খেলাঘরের কর্মসুচী দিয়ে শুরু হতো শহীদ দিবস পালনের কার্যক্রম ৷ এই প্রতিষ্ঠান ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে বিদ্যালয় মাঠে বনভোজনের ব্যবস্থা করতেন ৷ শতাধিক ছেলেমেয়ে নিজেরা চাল নিয়ে আসতাম ৷ যাদের সামর্থ্য ছিল তারা টাকা দিত ৷টাকার বিষয়টি বাধ্যতামূলক ছিল না ৷তবে নিজের খাবারের চাল দিতে হতো ৷ টাকার বিষয়টি বাধ্যতামুলক না থাকায় এটি পুষিয়ে নেয়ার জন্য আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে তরিতরকারি যোগার করতাম ৷ তরিতরকারি যোগার করাটা ছিল আনন্দের ৷খুব মজা করে যোগার করতাম ৷ আজকাল ঐ পদ্ধতিতে যোগার করলে নির্ঘাত থানায় অথবা বিচারের সম্মুখীন হতে হত ৷
কয়েকজন মিলে গ্রুপ করে পাতাকপির ক্ষেত থেকে পাতাকপি নিয়ে আসত ৷কোনো গ্রুপ পিঁয়াজ, কোনো গ্রুপ রসুন, এভাবে আলাদা আলাদা গ্রুপ আলু, টমেটো বিভিন্ন জনের ক্ষেত থেকে নিয়ে আসত ৷ তবে এ বিষয়ে সবার সজাগ থাকতে হত প্রয়োজনের চেয়ে বেশি নিয়ে আসা যাবে না এবং কোনো দরিদ্র কৃষকের ক্ষেত থেকে কিছু আনা যাবে না ৷ এতে একটি বিষয় ছিল যা নিয়ে আসা হতো তা আমাদেরই কোনো না কোনো সাথীর ক্ষেত থেকেই আসত ৷ যদিও না বলে এগুলো যোগার করা হত তবুও গ্রামের কেউ কিছু মনে করতেন না ৷ চেয়ে নিলে তাঁরা দিতেন , কিন্তু আমরা তাতে মজা পেতাম না বলেই কেউ চেয়ে নেয়ার পক্ষে ছিলাম না ৷
যাঁদের ক্ষেত থেকে আলু, পাতাকপি, পিঁয়াজ, রসুন, টমেটো ইত্যাদি নিয়ে আসতাম তাঁরা কেউ কিছু মনে করত না কারন তাঁদের ছেলেমেয়েরাই খায় এবং প্রতি বছর এইদিনে এভাবে পিকনিকের আয়োজন থাকতো তা সকলেই জানতেন ৷ গ্রামের প্রত্যেক পরিবারের ছেলেমেয়ে এই অনুষ্ঠানে থাকে ৷ সবচেয়ে বড় বিষয় তাঁরা আমাদের খুব ভালোবাসত ৷
রান্নার কাজটি করতেন বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী সকলের প্রিয় সাত্তার দা ৷ রাত বারোটার আগেই রান্না শেষ করে আমাদের খাওয়াতেন ৷বারোটা এক মিনিট এর সাথেই শুরু হতো প্রভাত ফেরি ৷ সবাই খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহন করি ৷আগেই একটি বাইসাইকেলে মাইক বাধা হতো ৷ হারমোনিয়াম গলায় ঝুলে বাজাতে শুরু করলে সকলে খালি পায়ে সারিবদ্ধ হয়ে প্রভাতফেরি তে অংশগ্রহন করতাম ৷ সবাই একসাথে গাইতাম " আমার ভায়ের রক্তে রাংগানো - - - - - ভুলিতে পারি৷" "ছালাম ছালাম হাজার ছালাম - - - শহীদ স্মরনে৷" ধুলা বালিময় কাঁচা রাস্তা৷ ধুলা বালি পেরিয়ে গান গাইতে গাইতে হাতীবান্ধা থানার ডাকবাংলা মাঠের শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতাম ৷ আমাদের গ্রাম থেকে ডাকবাংলার শহীদ মিনারের দুরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার ৷ গ্রামের ছেলে মেয়ে একসাথে রাতে প্রভাতফেরি করতাম , কোনোদিন কোনো সমস্যা হয় নাই ৷ প্রথম দিকে দুই তিন বছর নিজের গ্রামেই প্রভাত ফেরি করতাম ৷পরের বছরগুলোতে ডাকবাংলার শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আসতাম ৷ ফিরতে ফিরতে প্রায়ই ভোর হয়ে যেত ৷
ফুল সংগ্রহ করা একটি সমস্যা ছিল ৷ফুল কিনতে পাওয়া যায় , এ ধারনা ছিল না ৷ফুলের দোকানও ছিল না ৷ নিজ দায়িত্বে যে যার মত নিজ বাড়ি বা যাঁদের বাড়িতে ফুলের গাছ ছিল সেখান থেকে ফুল সংগ্রহ করত ৷
সকালবেলা সকলে স্কুলে যাই৷ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সকল ছাত্র ছাত্রী জমায়েত হই ৷বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের পরিচালনায় ম্যানেজিং কমিটি, স্থানীয় সুধীজন সহ সকলে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ৷ বিদ্যালয়ের সকল ছাত্র ছাত্রী র‍্যালী বের করি ৷ পারুলিয়া বাজার সহ প্রধান প্রধান রাস্তায় শ্লোগান দিতে দিতে প্রদক্ষিন করি ৷ শ্লোগান দিতাম "শহীদ দিবস শহীদ দিবস - অমর হোক অমর হোক" , বরকতের রক্ত- বৃথা যেতে দিব না, জব্বারের রক্ত - বৃথা যেতে দিব না সালামের রক্ত - -, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা - চালু করো চালু করো ইত্যাদি৷ এইদিন স্যান্ডেল বা জুতা পায়ে দিয়ে বিদ্যালয়ে আসতাম না ৷ সকলের পা খালি ৷ এভাবে আমরা দুই প্রতিষ্ঠানের আলাদা আলাদা কর্মসুচীতে অংশগ্রহন করে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতাম ৷
ওসমান গণি বাদশা, ছাইয়াকুল ইসলাম,বাবলু দা, রবি ভাইদের তত্ত্বাবধানে বছরের পর বছর শহীদ দিবস সহ অন্যান্য জাতীয় দিবস পালন করে এসেছি ৷তাঁরা যখন কর্মব্যস্ত তখন উত্তরসুরী হিসেবে আমরা এ দিবসটি পালন করেছি৷ আমরা যে যেখানেই থাকতাম ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করার জন্য একত্রিত হতাম ৷ একুশে পিকনিক, প্রভাতফেরি করতাম ৷ আনন্দের জন্য পিকনিক করি নাই ৷ সকলে একসাথে সঠিক সময়ে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহন করার সুবিধার জন্য ৷ শিক্ষা জীবনে এমন ভাবে বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িয়ে গেলাম আর গ্রামে গিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করার সুযোগ থাকলো না ৷ এখন মাঝে মাঝে যাওয়ার সুযোগ হয় , পিকনিকও নাই, প্রভাত ফেরিও নাই ৷
শাপলা শালুক খেলাঘর ও গ্রামের ঐ স্কুলের শিক্ষকগণ আমাদের মধ্যে যে দেশপ্রেম তৈরি করে দিয়েছেন - তাঁর তুলনা হয় না ৷দেশপ্রেম এর চেতনা বিদ্যালয়ই জাগরিত করার প্রকৃষ্ট সময় ৷ আমাদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার পথে এগিয়ে দেয়ার জন্য আজকের এই দিনে তাঁদের স্বশ্রদ্ধ সালাম জানাই৷

-শফিয়ার রহমান 
সহকারী শিক্ষক 
রংপুর জিলা স্কুল,রংপুর 
একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমার ছেলেবেলা : শফিয়ার রহমান। একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমার ছেলেবেলা : শফিয়ার রহমান। Reviewed by সম্পাদক on বুধবার, ফেব্রুয়ারী ২০, ২০১৯ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.