-->

৩রা নভেম্বর : কিছু কথা





ঈশা আল মাহিয়ান:

৩ নভেম্বর, ভোর ৪টা। বঙ্গভবনে একটি অস্থিরতা ভাব কাজ করছে। কারণ ২ তারিখে খাললেদ মোশাররফ শাফায়াতকে সাথে নিয়ে সেনাবাহিনীর একটা অংশ দ্বারা মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করেছে।

খালেদের অভ্যুত্থান ছিলো মোশতাক অন্যায়ভাবে গদি দখল করেছে এবং ফারুক-রশীদ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে এইসব কারণে। তবে খালেদ মোশাররফও ছিলেন উচ্চাভিলাষী অথচ সর্বোচ্চ পর্যায়ে নয়। তিনি ইচ্ছা করলে প্রেসিডেন্ট ও হতে পারতেন কিন্তু তার পরিকল্পনা ছিলো মোশতাককেই প্রেসিডেন্ট রাখবেন। অবশ্য শাফায়াতের ভেটোর কারণে মোশতাককে প্রেসিডেন্ট বানানো হয়না।তিনি চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীর মধ্যেই সর্বেসর্বা হবেন। চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ। পরবর্তীতে সিপাহি বিদ্রোহে তার মৃত্যু হয়।

যাইহোক, এই সময় অভ্যুত্থান ঘটাতে বঙ্গভবনে ফারুক, রশীদ, মোশতাক, ওসমানী কি করবেন তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় অস্থির। এই সময়টাতে চলতে থাকে টেলিফোন যুদ্ধ। খালেদ বঙ্গভবনে অবস্থানরত মেজরদেরকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। কিন্তু তারা অসম্মতি জানান। জেনারেল ওসমানীর সাথেও তার বাদানুবাদ হতে থাকে।

আতঙ্ক কাজ করে বঙ্গভবনে। এমন সময় একটি ফোনে রিং বেজে উঠলো। রশীদ ফোন কানে নিলেন, ওপাশ থেকে ভেসে আসলো "আমি ডিঅাইজি প্রিজন বলছি, প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে চাই।

- রিসালদার মোসলেহউদ্দিন কারাগারে পৌঁছেছেন? রশীদ আইজি প্রিজন নুরুজ্জামানকে জিজ্ঞাস করলেন।

- পৌছেছেন কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা তিনি এ কাজ কেন করবেন? নুরুজ্জামান আতঙ্কিতস্বরে জিজ্ঞাস করলেন।

- আপনি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলুন। এই রশীদ ফোনটি প্রেসিডেন্টের কাছে দিলেন।

- ঘাতক প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক ফোনটি ধরলে নুরুজ্জামান বললেন, স্যার! মুসলেহউদ্দিন সাহেব তো বন্দিদের গুলি করার কথা বলছেন।

- সে যা বলছে তাই হবে। এ বলে মোশতাক ফোনটি রেখে দিলেন।
স্তম্ভিত হয়ে যান আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান।

রশীদ বুঝতে পারলেন তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। ঘাতক রশীদ-ফারুক-মোশতাক একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন তাদের পতন হতে পারে। কিন্তু তারা কখনোই চান নি যে ভারতচক্র ক্ষমতায় আসুক। তাদের ভ্রান্ত ধারণা ছিলো। তারা মনে করতেন যে, আওয়ামীলীগ এ সোনার বাংলাদেশ ভারতকে দিয়ে দিচ্ছে।

যখন খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটালেন তখন তারা বুঝে নিলেন যে, খালেদ ভারতের সাহায্য নিবে। আওয়ামীলীগের নেতাদের ছেড়ে দিবে কারাগার থেকে। তারা জেলে বন্দি চার নেতার মাধ্যমে আওয়ামীলীগের পুনরুত্থান আঁচ করতে পারেন। তাই তারা পরিকল্পনা করলো জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করে দিলে আর কখনো আওয়ামীলীগের হাতে দেশ যাবেনা। অর্থাৎ ভারতের কাছে দেশ বিকিয়ে দিবেনা।

৩ নভেম্বর ভোরবেলা। ৪টার পরের কথা। কাকভোর। কাকেরা যখন ডাকাডাকি করে মানুষকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু আজ ভোরে এমন কিছু মানুষকেও ডাকিয়ে জাগাচ্ছে যারা প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন কিন্তু স্বাধীনভূমির লোকেরাই তাদের হত্যা করে।

রিসালদার মোসলেহউদ্দিন রশীদের আদেশক্রমে কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত হলেন। মোসলেহউদ্দিন সেই ব্যক্তি, যে ফারুক-রশীদের নেতৃত্বে নৃশংস হত্যাকাণ্ড অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারকে হত্যা করার সময় শেখ মনিকে হত্যা করে। সে কারাগারে গিয়ে বন্দি চারনেতার সেল দেখিয়ে দিতে বলেন কর্মকর্তাদের। একপর্যায়ে আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান আসেন এবং ব্যাপারটা শুনে আতঙ্কিত হয়ে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সাথে কথা বলেন।

প্রেসিডেন্টের কথা শুনে তিনি মোসলেহউদ্দিনকে তার কাজ করতে দিতে বাধ্য হন। যেন বাংলাদেশটাই জিম্মি হয়ে গেলো। যদিও এদেশ পরাধীন নয়।

কারাগারে বেজে উঠে পাগলা ঘণ্টা। সবাই জেগে উঠেন। হঠাত জাগানোতে সবাই অপ্রতিভ হয়ে গেলেন। কি ঘটতে যাচ্ছে কোন বন্দিই বুঝে উঠতে পারেন না।

কারাগারের ১ নং সেলে ছিলেন তাজউদ্দীন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম।পাশের সেলে ছিলেন মনসুর আলী আর কামরুজ্জামান। 
চারজনকেই ১নং সেলে আনা হয়। সারিবদ্ধভাবে তাদের দাঁড় করানো হয়। মোসলেউদ্দিন খুব কাছ থেকে চার নেতাকে গুলি চালান। সাথে সাথেই নজরুল, কামরুজ্জামান, মনসুর আলী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাজউদ্দীন তখনও জীবিত ছিলেন। তাঁর পেটে ও পায়ে গুলি পড়ে। তিনি অস্ফুটস্বরে মর্মভেদী আওয়াজ দিয়ে কাতরাতে থাকেন। পানি পানি বলে আওয়াজ করেন। কিন্তু এক ফোটা পানিও জুটলোনা তার মুখে। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যায় তার দেহ।

চলে যান পরপারে পানি পানি বলে এই তাজউদ্দীন, যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে একটি ডাকোটা বিমানে করে হন্ন হয়ে ঘুরে ঘুরে আওয়ামীলীগের অন্যান্য নেতাদের খুঁজে বের করেন অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য। তৈরি করেছিলেন দেশের প্রথম সরকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের যে গল্প শোনাবেন বলে বুকের মধ্যে গেঁথে রেখেছিলেন সে গল্পগুলো বুকের মধ্যে রেখেই বুকের রক্ত দিয়ে গেলেন। রক্তাক্ত হলো কারাগার। আরেকবার রক্তাক্ত হলো মাতৃভূমি যাকে রক্তাক্ত করেছে স্বয়ং মায়ের ভূমির সন্তানেরাই। রক্ত দিয়ে রচিত হলো বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আরেকটি নারকীয় জেলহত্যা। আমাদের করে গেলেন ঋণী।

বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো জাতীয় চারনেতার প্রতি!
তথ্যসূত্র : বইপোকা
৩রা নভেম্বর : কিছু কথা ৩রা নভেম্বর : কিছু কথা Reviewed by সম্পাদক on শনিবার, নভেম্বর ০৩, ২০১৮ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.